ইবি ছাত্রীর বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ


ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের খালেদা জিয়া হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে বহিরাগত এক নারীর সঙ্গে সমকামিতায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ওই ছাত্রীকে গতকাল মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) বিকাল ৪টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয় হল প্রশাসন।

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত ওই শিক্ষার্থী বলছেন, প্রথমত, তিনি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এবং অপর বহিরাগত নারী তাদের পারিবারিকভাবেই পরিচিত এবং একই বাসায় তারা থাকেন। দ্বিতীয়ত, ঘটনার সময় তিনি পরীক্ষার হলে ছিলেন, আবাসিক হলে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। তাই আপত্তিকর অবস্থায় দেখার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

অন্যদিকে হল প্রশাসনের পক্ষে থানায় দেওয়া লিখিত অভিযোগে অভিযোগকারী হিসেবে উল্লেখিত এক শিক্ষার্থী জানান, তিনি এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে রয়েছেন এবং অভিযুক্তদের এত দিন শুধু সন্দেহ হয়েছে, তবে নিজ চোখে কিছু দেখেননি। ফলে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।

সমকামিতার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন ইবির খালেদা জিয়া হলের শিক্ষার্থী মিলি (ছদ্মনাম) ও বহিরাগত নারী মিমি (ছদ্মনাম)।

মঙ্গলবার সকালে হলের নতুন ব্লকের তৃতীয় তলায় এ ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে হলের ফ্লোরের শিক্ষার্থীদের মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক নোটিশে ওই ছাত্রীকে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

বহিরাগত ওই নারী বেআইনিভাবে হলে থাকেন এবং মাঝেমধ্যে আবাসিকে ওই ছাত্রীর সঙ্গে সমকামিতায় লিপ্ত হন বলে উল্লেখ করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়ে ওই নারীকে সোপর্দ করা হয়।

হল প্রশাসনের নোটিশে বলা হয়েছে, ‘খালেদা জিয়া হলে নতুন ব্লকের আবাসিক ছাত্রী মিলি খাতুনের (ছদ্মনাম) কক্ষে বহিরাগত একজন মেয়ে মাঝেমধ্যে অবস্থান করে। ওই কক্ষের ছাত্রীরা তাদের আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায় এবং বিষয়টি হল কর্তৃপক্ষকে অবগত করে। এ অবস্থায় হল কর্তৃপক্ষের জরুরি সভায় এই ফ্লোরের সব ছাত্রীর মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে ওই ছাত্রীকে ২১ জানুয়ারি বিকাল ৪টার মধ্যে হল ত্যাগ করতে নির্দেশ দেওয়া হলো এবং বহিরাগত মেয়েকে পুলিশে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো।’

অভিযোগ বিষয়ে অভিযুক্ত মিলি (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার মানোন্নয়নের পরীক্ষা চলছে। আমি পরীক্ষার হলে ছিলাম। হল থেকে শুনেছি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমারই এক ফ্রেন্ড গিয়ে বলল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুই হলে যা, হলে কিছু একটা হয়েছে। তারপর আপনারা যা জানতে পারছেন, আমিও তা জেনেছি। আমি ছিলাম পরীক্ষার হলে, আর গেস্ট ছিল হলের রুমে। তাহলে কীভাবে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পেল? আমি প্রভোস্ট স্যারের কাছে প্রমাণ চেয়েছি, স্যার বলেছেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। আপাতত তুমি হলের বাইরে থাকো।’

বহিরাগত নারী কে, এ বিষয়ে মিলি বলেন, ‘ও আমার ফ্যামিলি রিলেটিভ। পাশাপাশি আমার ফ্রেন্ড। আমি, আমার হাজবেন্ড, আমার ছোট ভাই, দেবর এবং মিমি (নারী) ওর মা-সহ একই বাসায় অবস্থান করি। তাহলে অভিযোগকারীদের ভাষ্যমতে যদি আমি এ রকম কিছুর সঙ্গে জড়িত, তাহলে বাসা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এমন করার কোনো যুক্তি আছে? আমার মানসিক অবস্থা ভালো না। আমার সংসার আছে। এগুলো এভাবে ছড়ানোয় আমার পরিবারে প্রভাব পড়ছে। আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। আগামীকাল আমার পরীক্ষা আছে, পরীক্ষার পর আমি হল বডির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব।’

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ওই নারী বলেন, ‘আমি সকালের দিকে ঘুমিয়ে ছিলাম। এর মধ্যে রুমে ঢুকে দরজা আটকে হলের মেয়েরা এই অভিযোগ দিয়ে আমাকে এখানে নিয়ে আসে। আমি তাদের বললাম যে এলিগেশনের কথা বলছেন কিন্তু কোনো প্রমাণ দেখাইলেনও না, শোনালেনও না; ধরে এখানে নিয়ে এসে আসলেন কিন্তু উনারা আমার কোনো কথা শোনেননি আমাকে কিছু বলেনওনি। এখানে কতবার এসেছি, কত দিন ধরে যাতায়াত করছি, এসব তথ্য জিজ্ঞেস করে থানায় নিয়ে এসে অভিভাবকদের ফোন করে দিল।’

এ বিষয়ে হল প্রশাসনের পক্ষে থানায় লিখিত অভিযোগকারী শ্রাবণী বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) কী হইছে, তা আমি জানি না। আমি ১২ তারিখে বাসায় এসেছি। বিষয়টা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়েছে শুধু, কিন্তু এমন না যে আমি নিজ চোখে তাদের ওভাবে দেখেছি। আমার কাছে আমাদের বান্ধবীদের সম্পর্কের তুলনায় তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অন্য রকম মনে হয়েছে। সেখান থেকে সন্দেহ হয় যে তাদের মধ্যে এ রকম হতে পারে কিন্তু আমার কাছে কোনো সলিড প্রমাণ নেই। আর আমি খুবই ব্যস্ত থাকি। কে কী করল সেটা দেখার সময় ওতটা নেই বললেই চলে।’

বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ওই ছাত্রী পরীক্ষার হলে ছিল কি না, সেটা আগামীকাল নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে বলতে হবে। তবে বিভাগে মানোন্নয়ন পরীক্ষা চলছে, এটা সত্য।’

এ বিষয়ে খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘১০টার পরপর ছাত্রীরা বিষয়টি আমাকে জানায়। বহিরাগত মেয়েটা এবারই প্রথম এসেছে তা নয়, আগেও তিন-চারবার এসেছে এবং প্রতিবার চার-পাঁচ দিন করে থাকত। রুমে তাদের অবস্থান নিয়েও আপত্তি আছে, মেয়েরা আগেও বিভিন্ন সময় তাদের অন্যভাবে দেখেছে। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পুরোটাই আইউইটনেস (চাক্ষুস সাক্ষী), কোনো ভিডিও রেকর্ড নাই। তবে আমরা যখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি, তখন তার আচরণ ও কথাবার্তা সন্দেহজনক ছিল। থানায় যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন হাউজ টিউটরদের সঙ্গে মেয়েরাও গিয়েছে, তারা সাক্ষ্য দিয়েছে।’

শ্রাবণী আক্তারের বক্তব্যের সূত্র ধরে জানতে চাইলে প্রভোস্ট বলেন, ‘আপনাদের গণমাধ্যমে সে কী বলেছে, সেটা আমি জানি না। কিন্তু হলের মেয়েরা আমাদের সামনে অভিযোগ দিয়েছে। আপত্তিকর অবস্থার বিষয়ে ফ্লোরের মেয়েদের রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে, আমাদের না। মেয়েরা ওই মুহূর্তে দেখেনি কিন্তু কয়েক দিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে তারা আজ স্টেপ নিয়েছে। মেয়েদের হল অনেক সেনসিটিভ জায়গা। অনেক সময় অনেক মেয়ে এসে কোনো দাবি বা অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামলাতে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়।’

অন্য কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও মেয়েদের সাক্ষ্যর ওপর ভিত্তি করে ওই শিক্ষার্থীকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথমত, দীর্ঘ সময় সে হলে ছিল না; একবার সিট বাতিল করার পরও তাকে মানবিক কারণে সিট দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সে প্রেগন্যান্ট এবং তৃতীয়ত, আজ উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি। এসব কারণে তাকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো ছাত্রী হলেই প্রেগন্যান্ট মেয়েকে রাখা হয় না। আমরা তার সিট বাতিল করিনি, শুধু বিষয়টি তদন্তের স্বার্থে আপাতত হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরে সব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ 

উল্লেখ্য, এই প্রতিবেদকের সঙ্গে হল প্রভোস্টের কথা হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই হলের নোটিশ বোর্ডে লাগানো নোটিশটি তুলে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হলের একাধিক শিক্ষার্থী।

নবীনতর পূর্বতন