রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে এর আগে শীর্ষ দুই পদে শিবির জয়ী হতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৬ বার অনুষ্ঠিত হওয়া রাকসু নির্বাচনে জয়ী ৩২ জন ভিপি-জিএসের মধ্যে বাম ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ১৩ জন। এবারের নির্বাচনে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং ছাত্রদলের প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। এর বিপরীতে ছাত্রশিবির রাকসুর ২৩ পদের ২০, সিনেটের পাঁচ পদের তিন এবং ১৭ হলের ৫১ শীর্ষ পদের সব জয়লাভ করেছে।
ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বিপুল ব্যবধানে জয় পেয়েছেন। এই নিরঙ্কুশ বিজয়ের নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে শিবির প্রকাশ্যে ছিল না। গোপনে কর্মসূচি চালাতে থাকে। ঐক্যবদ্ধ ছিল। অভ্যুত্থানের পর প্রকাশ্যে আসে। হলে হলে কমিটি দেয়। কমিটির সদস্যরা এক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে নানা কল্যাণমূলক কাজ করেন। এ কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের ভালো অবস্থান তৈরি হয়। এই ভালো কাজগুলো নির্বাচনের মাঠে প্রভাব ফেলে। ভাসমান ভোটাররা শিবিরের গত এক বছরের কাজগুলো মূল্যায়ন করে তাদের ভোট দেন। এভাবে শিবির প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতা এবং ছাত্রদল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যেতে পারেনি। তারা দলীয় থেকে গেছে। কিন্তু ছাত্রশিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট প্রয়োজনে পাশে ছিল। তাই সব ক্যাম্পাসে তারা শিবিরকে পছন্দের তালিকায় রেখেছে।’
ভিপি-এজিএস পদে জয়ের কৌশল
ভিপি পদপ্রার্থী ও শাখা শিবিরের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীবের সঙ্গে। সজীব গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির পদত্যাগকারী যুগ্ম আহ্বায়ক। জুলাই আন্দোলনে ক্যাম্পাসে শক্ত অবস্থান ছিল। তিনি ভিপি পদে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তৈরি করেছিলেন প্যানেলও।
সূত্র জানায়, সজীব শিবিরের সঙ্গে সমঝোতা করে অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁকে কোনো ধরনের প্রচারণাও চালাতে দেখা যায়নি। সজীব সরে যাওয়ায় এই পদে সহজে জয়লাভ করেন জাহিদ।
এদিকে এজিএস পদে শিবিরের প্রার্থী সালমান সাব্বিরের সঙ্গে লড়াই হয় ছাত্রদলের প্রার্থী জাহিন বিশ্বাস এষার। এই পদে আরও একজন হেভিওয়েট প্রার্থী ছিলেন সাবেক সমন্বয়ক আকিল বিন তালেব। আকিল ও সাব্বিরের মধ্যে ভোট কাটাকাটি হয়ে এষা জয়ী হয়ে যেতে পারেন– এমন সম্ভাবনা ছিল। সেই ভয় থেকে আকিলের সঙ্গে সমঝোতা করে ছাত্রশিবির।
শিবিরের একাধিক সূত্র জানায়, আকিল বিন তালেব যদি এজিএসে বসে যান, তবে তাকে সিনেটে সমর্থন দেবে বলে জানায় শিবির। এই শর্তে রাজি হয়ে এজিএস থেকে সরে যান তিনি। শিবিরের একাধিক নেতাকর্মী নিশ্চিত করেন, তারা দলীয় নির্দেশনায় আকিল বিন তালেবকে ভোট দেন। আকিল পাঁচ হাজার ৭০৭ ভোট পেয়ে সিনেট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
বাম ছাত্র সংগঠনগুলো দুর্বল
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি-জিএস পদে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছিলেন। পরের নির্বাচনগুলোতে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রার্থীরা একটি বা দুটি শীর্ষ পদে নিয়মিত নির্বাচিত হন। ১৯৮৮-৮৯ সালের সংসদে বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্র মৈত্রীর প্রার্থী রাকসুতে ভিপি নির্বাচিত হন। সবশেষ ১৯৮৯-৯০ সংসদে ভিপি হন ছাত্রদলের প্রার্থী এবং জিএস হন ছাত্রলীগ জাসদের প্রার্থী। তবে নির্বাচিত না হলেও ক্যাম্পাসে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর ভালো অবস্থান ছিল। বিগত ১৫ বছরে ক্যাম্পাসে ধীরে ধীরে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর অবস্থান দুর্বল হতে থাকে। বিভক্তি এবং সাংগঠনিক দুর্বলতায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা বামপন্থি রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। সদস্যের অভাবে সাতটি বাম ছাত্র সংগঠন মিলে ২৩ পদের বিপরীতে ১৬ সদস্যের প্যানেল দেয়। ভোটের মাঠেও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি তারা।
নির্বাচনে ভিপি পদে জয়ী ছাত্রশিবিরের প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ পান ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট। বিপরীতে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোর প্যানেলের প্রার্থী ফুয়াদ রাতুল পান ২৩৭ ভোট। জিএস পদে জয়ী প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার পান ১১ হাজার ৫৩৭ ভোট এবং বামপন্থি কাউসার আহমেদ পান ২৯৯ ভোট। এজিএস পদে জয়ী প্রার্থী এস এম সালমান সাব্বিরের ছয় হাজার ৯৭১ ভোটের বিপরীতে বামপন্থি প্রার্থী নাসিম সরকার পান ১৭১ ভোট।
১৯৮৮-৮৯ সালে বামপন্থি ছাত্র সংগঠন ছাত্র মৈত্রীর প্যানেল থেকে ভিপি নির্বাচিত হন রাগীব আহসান মুন্না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সমকালকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসগুলোতে ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষমতায় ছিল। ক্যাম্পাসে বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানচর্চার রাজনীতির পরিবর্তে স্থান পায় শক্তি প্রদর্শন ও অর্থের রাজনীতি। এসব কারণে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট হয়। শিক্ষার্থীরা বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলোতে যুক্ত হতে কম আগ্রহ প্রকাশ করেন। যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হয় এবং জাতীয় নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনঃস্থাপিত হয়, দ্রুত এই অবস্থার পরিবর্তন হবে।
সাবেক সমন্বয়ক থেকে জিএস আম্মার
শীর্ষ দুই পদে শিবির জয়ী হলেও জিএস পদে কৌশল খাটেনি। কেন্দ্রীয় সংসদে জিএস ও সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার। তবে আম্মারের আধিপত্যবিরোধী প্যানেল থেকে কেন্দ্রীয়, হল সংসদ ও সিনেটে কেউ জয়লাভ করেননি। শিবিরের জিএস প্রার্থীকে প্রায় ছয় হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন তিনি। অভ্যুত্থানে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিতি পান। এর আগেও শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া, অধিকার আদায়সহ ফ্রি প্যালেস্টাইন মুভমেন্টের মাধ্যমে পরিচিত ছিলেন। অভ্যুত্থানের পর তিনি পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। বিভিন্ন উপদেষ্টা ও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কাছে পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে স্মারকলিপি দেন। আন্দোলনের মুখে গত জানুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা বাতিল করা হয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর তা ফিরিয়ে আনে প্রশাসন। এতে প্রশাসনের বিরুদ্ধে আবার আন্দোলন শুরু হলে উপ-উপাচার্যের সঙ্গে আম্মারের ধস্তাধস্তি হয়। পরে আন্দোলনের মুখে প্রশাসন এই কোটা আবার স্থগিত করে। এই আন্দোলনে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ে।
সংস্কৃতিমনা হওয়ায় ক্যাম্পাসের প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের কাছেও আস্থা অর্জন করেন আম্মার। এদিকে বাগছাসের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আধিক্য থাকায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা রাবি শিক্ষার্থী আরেক যুগ্ম আহ্বায়কের সঙ্গে যুগ্ম সদস্য সচিব সালাহউদ্দিন আম্মার পদত্যাগ করেন।
সাংগঠনিক দুর্বলতায় ছাত্রদলের ভরাডুবি
ছাত্রদল চার বছর ধরে চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। গত ১৬ আগস্ট তারা ক্যাম্পাসে কমিটি দেয়। সভাপতি-সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতাদের নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই। ভোটের আমেজ শুরু হলেও প্যানেল গোছাতে পারেনি। অনেক আগে থেকে শিবিরের প্রার্থীরা ভোটারদের সামনে দৃশ্যমান হন। ছাত্রদল শেষ মুহূর্তে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্যানেল দেয়। জুলাই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ছাত্রনেতা ও শাখার ১ নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান মিঠু কোন্দলে প্যানেল থেকে বাদ পড়েন।
একাধিক প্রার্থী ও নেতা জানান, দেরিতে প্যানেল দিলেও কোন্দলে ছাত্রদল একাত্ম হয়ে কাজ করেনি। ভিপি-জিএস ছাড়া অন্য পদের প্রার্থীরা ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের প্রচারণায় গুরুত্ব পাননি।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের এক শীর্ষ নেতা সমকালকে জানান, গত ১৫ বছরে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে টিকতে পারেনি। এ সময় শিবির সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড়ালে ছাত্রলীগের সঙ্গে মিশে ক্যাম্পাসে ছিল। অভ্যুত্থানের পরও ছাত্রদলের অবস্থান ছিল ভঙ্গুর। সেখান থেকে জনপ্রিয় ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের দিয়ে প্যানেল তৈরি করা হয়েছিল। স্বল্প সময়ে এই প্যানেল শিক্ষার্থীদের মাঝে পরিচিতি লাভ করে। শিবিরের শক্তিশালী একটি ইউনিটের বিপরীতে ছাত্রদলের নেতারা চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছেন।
হল সংসদের শীর্ষ পদগুলো শিবির ও ছাত্রী সংস্থার
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদ নির্বাচনে শীর্ষ তিন (ভিপি, জিএস ও এজিএস) পদে ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থা সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এ ছাড়া হল সংসদগুলোতে ৪২ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছাত্রী ৩৯ জন এবং ছাত্র তিনজন। তাদের ৩৮ জন শিবির ও ছাত্রী সংস্থার প্যানেলের। বাকিদের মধ্যে ছাত্রদলের একজন ও তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী। অন্যদিকে চারটি ছাত্রী হলে একটি করে পদে কোনো প্রার্থী পাওয়া যায়নি।
সিনেটে পাঁচজনের মধ্যে শিবিরের তিন
সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে পাঁচটি পদের বিপরীতে ১২ হাজার ৮৩৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও রাকসু ভিপি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ (৯ হাজার ৪৬৭ ভোট)। তৃতীয় অবস্থানে আছেন শিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী ও সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজা (৮ হাজার ২০৫ ভোট)। চতুর্থ অবস্থানে সাবেক সমন্বয়ক আকিল বিন তালেব (৫ হাজার ৭০৭ ভোট)। পঞ্চম অবস্থানে শিবির সমর্থিত প্যানেলের নির্বাচিত এজিএস সালমান সাব্বির (৪ হাজার ৬৯০ ভোট)।
ফল ঘোষণার পর উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব ফেসবুকে লিখেছেন, ৩৫ বছর পর রাকসু প্রাণ ফিরে পেল। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই জিতে গেছে। যারা নির্বাচিত হয়েছে, তাদের মনে রাখতে হবে, পদ উপভোগের বিষয় নয়। এটা আমানত। দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য কাজ করতে হবে। রাকসু দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্ল্যাটফর্ম নয়। অতি-রাজনীতি যেন রাকসুর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত না করে।
সূত্র: সমকাল