আব্দুর রহিম: ডাকসু নির্বাচনের হাত ধরে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মতো নোয়াখালী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তারা জানতে চান, কবে অনুষ্ঠিত হবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ কলেজ র্যাংকিং-এ বিভাগীয় পর্যায়ে শীর্ষ তৃতীয় স্থানে থাকা নোয়াখালী জেলার ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে নানান জল্পনা কল্পনা।
নোয়াখালী সরকারি কলেজ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (নোকসু) নির্বাচনের পক্ষে বিপক্ষে শিক্ষার্থীদের মতামত সংগ্রহের জন্য সম্প্রতি একটি জরিপ পরিচালনা করেছে নোয়াখালী সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতি। জরিপে ৮৮.২% শিক্ষার্থী ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পক্ষে এবং ১১.৮% বিপক্ষে ভোট প্রদান করেছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ০৮ অক্টোবর পর্যন্ত দুই সপ্তাহ ধরে অনলাইনে গুগল ফর্মের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এ জরিপ। জরিপে মোট মোট ৪৮৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। ইংরেজি, গণিত, ইসলামিক স্টাডিজ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদবিজ্ঞান সহ প্রায় সকল বিভাগের অনার্স ও মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা জরিপে অংশ নেয়। এছাড়াও ডিগ্রি (পাস) কোর্সের শিক্ষার্থীরাও এতে অংশ নেয়।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হলো শিক্ষার্থীরা। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতি শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া ও প্রয়োজনীয় চাহিদা থাকে। এসব দাবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরতে এবং সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ছাত্র সংসদ। একটি গণতান্ত্রিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ছাত্র সংসদের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এটি শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক চর্চা শেখায় এবং নেতৃত্বগুণ তৈরিতে সহায়তা করে। আগামীর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশ পরিচালনায় যোগ্য করে গড়ে তুলতে ছাত্রসংসদের গুরুত্ব অপরিহার্য।
জানা গেছে, সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে নোয়াখালী সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর পর থেকে দীর্ঘ ২৮ বছর ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একক আধিপত্য বিস্তারের ফলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। তৎকালীন সময়ে কলেজের ছাত্র সংসদ ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের কার্যালয়ের মতো করে দখল করে রেখেছিল।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবছর ছাত্র সংসদ বাবদ ২৫ টাকা করে আদায় করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই টাকার কোনো হিসেব শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপস্থাপন করা হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে কোনো ছাত্র সংসদ নেই, তাহলে কোথায় ব্যয় হচ্ছে এই টাকা? এমন প্রশ্নই তুলছেন অনেক শিক্ষার্থী।
ছাত্র সংসদ ঘিরে শিক্ষার্থীদের ভাবনা: নোয়াখালী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ রাকিব বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালীর ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান নোয়াখালী সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার, চাহিদা ও সমস্যাগুলো যথাযথভাবে তুলে ধরার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক শিক্ষাঙ্গনের মূল শক্তি হলো নির্বাচিত নেতৃত্ব। নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারছে না, তাদের সমস্যা ও দাবি যথাযথভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।
নোয়াখালী সরকারি কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মামুনুর রশীদ বলেন, ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চা করবে। এতে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে ও শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হবে। আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ না থাকায় নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
ছাত্র সংসদ নিয়ে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের ভাবনা:
নোয়াখালী সরকারি কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি মুহাম্মদ আব্বাস উদ্দিন বলেন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, সারা বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ সমূহে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়ার জন্য বার বার দাবি তুলে আসছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পছন্দের নেতৃত্ব উঠার সুযোগ পাবে। শিক্ষা বান্ধব ক্যাম্পাস নির্মিত হবে। শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার বিল্ডাপে যুগোপযোগী উদ্দ্যাগ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাছাড়া ক্ষমতাসীন অথবা বড় দলের ছাত্র সংঘটনের আধিপত্য কমে আসবে। ত্রাসের রাজনীতি থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত করা যাবে। অতএব,আমাদের জোরালো দাবি হচ্ছে,অতি সত্তর নোয়াখালী সরকারী কলেজে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করে "নোকসু" নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক।
নোয়াখালী সরকারি কলেজ শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আমি ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে দেখি একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ হিসেবে। এটি নেতৃত্বের চর্চা ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের পথ। তবে সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রভাব যেন না আসে, সেই প্রত্যাশা করি। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ ও শিক্ষার্থীবান্ধব নির্বাচন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নোয়াখালী সরকারি কলেজের সাবেক সমন্বয়ক ও নোয়াখালী জেলার সাবেক সিনিয়র মূখ্য সংগঠক নাহিদা সুলতানা ইতু বলেন, দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া এটা জুলাইয়ের আকাঙ্খা। জেলার প্রাচীন ও সুনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নোয়াখালী কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন সমস্যা সমাধান এবং অধিকার আদায়ে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে নেতৃত্বের ভার বুঝিয়ে দেওয়া এবং গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নোয়াখালী সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হোক।
নোয়াখালী সরকারি কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি নাজিম মাহমুদ শুভ বলেন, নোয়াখালী সরকারি কলেজে ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কলেজ প্রশাসনের উদাসীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে কখনো কখনো শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশ, নেতৃত্ব বিকাশ ও অংশগ্রহণমূলক চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা মনে করি, ছাত্রসংসদ নির্বাচন শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার এবং তা বিলম্ব না করে অবিলম্বে আয়োজন করতে হবে। নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে কলেজে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া, শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সমস্যা সমাধানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকা অপরিহার্য। তাই নোয়াখালী সরকারি কলেজ ছাত্রশিবির কলেজ প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছে—অবিলম্বে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন ঘোষণা করা হোক।
নোয়াখালী সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, নোয়াখালী সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে আমরা ছাত্রদল স্বাগত জানাই। তবে এই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক না হলে তা অর্থহীন হয়ে পড়বে। আমরা চাই, সব দলের ছাত্রদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হোক। কোনো পক্ষের প্রভাব বা প্রশাসনের পক্ষপাত ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করবে—এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক ও সজাগ। ছাত্রদল বিশ্বাস করে, ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ছাত্রদের অধিকার রক্ষায় শক্ত অবস্থান নেওয়া সময়ের দাবি। ডাকসুর মতো করে ইঞ্জিনিয়ারিং যেন না হয়।
এ বিষয়ে নোয়াখালী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ জাকির হোসেন বলেন, ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো এবং শিক্ষার্থীরা চাইলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। তবে এটা তো আমাদের একক সিদ্ধান্তে করতে পারব না, এটি মূলত সরকারি সিদ্ধান্ত। আগে বড় কলেজ গুলো শুরু করুক। মন্ত্রণালয় থেকে বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি আমাদের চিঠি ও নীতিমালা দেওয়া হয় এবং ছাত্র সংসদ করতে বলা হয় , তখনই আমরা কার্যক্রম শুরু করতে পারব। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত হলেও সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়। আর আমাদের কলেজ তো পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠান।