বিপ্লবী চে গেভারার ৫৭তম মৃত্যুদিবস আজ

বিপ্লব, ত্যাগ ও সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক চে। পৃথিবী তাকে চে গেভারা নামে চিনলেও, তার প্রকৃত নাম এর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা।

বিপ্লবী চে গেভারার ৫৭তম মৃত্যুদিবস আজ
৭ অক্টোবর, ১৯৬৭। ইউরো গিরিখাত ঘিরে ফেলেছে আমেরিকার প্রশিক্ষণ নেয়া বলিভিয়ার সেনারা। বৃত্ত ছোট করতে করতে ক্রমশ এগিয়ে আসছে তারা। চারপাশ থেকে বিকট শব্দে ছুটে আসছে হ্যান্ড মেশিনগানের গুলি। চারিদিকে লুটিয়ে পড়ে আছে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া বিশ্বস্ত সঙ্গীদের মরদেহ। গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে নিজের দুটো পা। হাত থেকে ছিটকে ঝোঁপের আড়ালে হারিয়ে গেছে বহুদিনের সঙ্গী রাইফেলটিও। এই অবস্থায় একটি হাভানা চুরুট জ্বলানোই বোধহয় সমীচীন লেগেছিল তার। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পকেট থেকে হাভানা চুরুট বের করতেই যাবেন, এমন সময় সামনে এসে দাঁড়াল জনাকয়েক বলিভিয়ান সেনা। রাইফেল তাক করা হলো তার ওপর। তিনি হাতের তালু দিয়ে ঠেকালেন তাক করে রাখা রাইফেল। বললেন, ”গুলি কোরো না। আমি চে গেভারা। মৃত চে গেভারার চেয়ে জীবিত চে গেভারার দাম অনেক বেশি।"

বিপ্লব, ত্যাগ ও সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক চে। পৃথিবী তাকে চে গেভারা নামে চিনলেও, তার প্রকৃত নাম এর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা। ১৯৬৭ সালের আজকের এই দিনে বলিভিয়ায় হত্যা করা হয় বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ চে গেভারাকে। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন অকুতোভয় বীর বিপ্লবী।

আর্জেন্টিনার লোক হয়েও কিউবাকে স্বাধীন করার কৃতজ্ঞতায় বন্ধু চে গেভারাকে কিউবার মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন আরেক বীর বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো। কিন্তু রক্তে যার বিপ্লবের আগুন, মন্ত্রিত্বে তার মন ভরে না! তাই মন্ত্রিত্ব প্রত্যাখ্যান করে চে নেমে পড়ছিলেন আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। শুরু করেছিলেন বলিভিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ। তৈরি করেছিলেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (বলিভিয়া)। কিন্তু তাকে প্রতিহত করতে আঁটঘাট বেধেই নেমেছিল তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা।

দুর্গম ও সংকীর্ণ ইউরো গিরিখাতের মধ্যে চে গেভারার গোপন গেরিলা ক্যাম্পের হদিশ পেয়ে ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর সূর্যোদয়ের আগেই জঙ্গল ঘিরে ফেলেছিল আমেরিকার মদদপুষ্ট দুই ব্যাটেলিয়ান বলিভিয় সেনা। সংখ্যায় তারা ছিল ১৮০০ জন। শুরু হয়েছিল এক অসম যুদ্ধ। শেষও হয়েছিল দ্রুতই। আমেরিকার হাতের পুতুল, বলিভিয়া সরকারের সেনাদের হাতে আটক হয়েছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বকাঁপানো গেরিলা নেতা এর্নেস্তো চে গেভারা।

রক্তঝরা আহত পায়েই তাকে ৪ মাইল পাহাড়ি পথ হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বলিভিয় সেনারা। বাকি দিনটা আহত চে গেভারার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। তারপরও বলিভিয় আর্মি কমান্ডাররা জীবিত কমরেডদের সম্পর্কে চে গেভারার মুখ থেকে একটি শব্দ বের করতে পারলেন না। আহত হাতে কমান্ডারের কাছ থেকে চেয়ে নেয়া তামাক পাইপে পুড়ে যেতে লাগলেন নির্বাক ভঙ্গিতে। ৮ তারিখ রাতে, গেভারার বিখ্যাত পাইপ নিজের কাছে স্মারক হিসাবে রাখবার জন্য গেভারার ঠোঁট থেকে ছিনিয়ে নিতে যান বলিভিয় আর্মি অফিসার ক্যাপ্টেন এসপিনোসা। সে সময় হাত বাঁধা অবস্থাতেই এসপিনোসাকে জোড়া পায়ে লাথি মেরে দূরের দেয়ালে ফেলে দেন চে গেভারা।

এরপর ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট রেনে ব্যারেন্টোস সকাল দশটা নাগাদ চে গেভারাকে হত্যা করার আদেশ দেন। আমেরিকা চাইছিল জীবিত চে গেভারাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পানামা নিয়ে যেতে। কিন্তু বলিভিয়ার নেতৃত্ব চাইছিল চে-এর মৃত্যু। কারণ তারা ভয় পাচ্ছিল জনসমক্ষে চে-এর বিচার হলে, চে গেভারা পুরো বলিভিয়ার মানুষের সহানুভূতি পাবেন। ফলে আবার উস্কে উঠবে বলিভিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন। এছাড়াও সমর কৌশলে কিংবদন্তি চে গেভারা, কখন কীভাবে জাল কেটে বেরিয়ে যাবেন কেউ জানে না। তাই আমেরিকাসহ সারা বিশ্বকে বোকা বানাতে সাজানো হল ছক। আটক অবস্থায় অত্যাচার করে মারার কথা চেপে গিয়ে পুরো বিশ্বকে জানানো হলো, যুদ্ধে মারা গেছেন অবিসংবাদিত গেরিলা নেতা চে গেভারা।

মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্তও এই বিপ্লবী ভেবে গেছেন মুক্তিকামী মানুষর কথা। ৯ অক্টোবর, অর্থাৎ মৃত্যুর সকালে চে গেভারা গ্রামের কয়েকজন স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে জুলিয়া কোর্তেজ নামে একজন ২২ বছর বয়সী শিক্ষিকা পরে বলেছিলেন সামান্য কথা বার্তা। তারই মধ্যে চে গেভারা জুলিয়াকে তাকে আটকে রাখা ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত স্কুলের ছাদ দেখিয়ে বলেছিলেন, "এই হল স্কুলের অবস্থা। আর আপনি কি মনে করছেন, বলিভিয়ার ছাত্ররা শিক্ষিত হবে? গভর্মেন্ট অফিসাররা কিন্তু মার্সিডিজ গাড়ি চালাচ্ছেন। আমরা এর বিরুদ্ধেই লড়ছি।"

আজ ৯ অক্টোবর, ২০২৪। বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ চে গেভারার ৫৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। অথচ মৃত্যুর ৫৭ বছর পরেও সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, চে গেভারার মুখ আঁকা টি শার্ট, বেরেট টুপি, ব্যানার। আর্জেন্টিনার প্রবাদপ্রতীম ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনার বাহুর উল্কিতে ফুটে ওঠে চে গেভারার মুখ। আজও কিউবার সান্টাক্লারাতে চে গেভারার সমাধিতে সারা বিশ্ব থেকে ফুল দিতে আসেন লাখ লাখ মানুষ। আজও চে গেভারার বধ্যভূমি, বলিভিয়ার স্কুল বাড়িটিকে মানুষ দেখতে যান। আজও বলিভিয়ারই লা হিগুয়েরা শহরকে পাহারা দিচ্ছে চে গেভারার সুবিশাল ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। যার নিচে লেখা— তুমিই এনেছ নতুন প্রভাত।

তথ্য সূত্র : ডেথ অফ আ রেভুলিউশনারি: চে গেভারা’স লাস্ট মিশন- রিচার্ড হ্যারিস ও অন্যান্য।
Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.