এহসান হক:
গত বছর সৌদি আরবের ডেটা এবং এআই মন্ত্রণালয়ের অফিসে বসে আছি। মন্ত্রণালয়ের প্রধান গবেষকের দায়িত্বের বোঝা তখন আমার কাঁধে। এমন সময় হঠাৎ হিউম্যান রিসোর্স থেকে ফোন এল—‘স্যার, নতুন একজন যোগ দিয়েছেন। পরিচয় করিয়ে দিতে আপনার অফিসে নিয়ে আসছি।’পাঁচ মিনিট পর দরজায় এক তরুণ হাজির। পরিপাটি পোশাক, সদ্য পিএইচডি শেষ করেছেন। নাম বললেন, সাইফুল বারি মারুফ । আমি তাঁকে স্বাগত জানালাম ।
কিন্তু সাইফুল প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, আপনি কি বাংলাদেশি?’
আমার মুখে এক চিলতে হাসি। ভাবলাম, এ তো দেখি একদম নিজের মানুষ! আমাদের অফিসে বাংলাদেশিরা কাজ করেন ঠিকই, তবে বেশির ভাগ পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। পিএইচডি ডিগ্রিধারী একজন বাংলাদেশিকে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে তো আমার আনন্দের সীমা নেই!
সাইফুল যোগ দিলেন ‘আল্লাম’ টিমে। আল্লাম—যার পুরো নাম ‘অ্যারাবিক লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’। তখন টিমের অবস্থা ছিল টাইটানিকের মতো। দুই মাস আগে একটা প্রেস রিলিজ দিয়ে আল্লামের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু প্রোডাক্ট পুরোপুরি ব্যর্থ। টিমের আত্মবিশ্বাস তখন কফির মগে ডুবে ছিল।
তখনই এলো সাইফুলের জাদু। মানুষটা কী করলেন, কে জানে! কয়েক মাসের মধ্যেই আল্লাম নতুন জীবন পেল। টিমের জটিল সমস্যাগুলো এমনভাবে সমাধান করল, যেন ম্যাজিক শো চলছে। সাইফুল হয়ে উঠলেন আমাদের ‘টিম সুপারম্যান’।
আপনারা নিশ্চয়ই চ্যাটজিপিটির নাম শুনেছেন। এটা একটা ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারঙ্গম। কিন্তু এটি ইংরেজি ভাষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, ফলে বাংলা বা আরবিতে এর কার্যকারিতা সীমিত।
কিন্তু ভাষার জটিলতা বোঝা কি এত সহজ? ধরুন, বাংলা শব্দ ‘দাদা।’ এর মানে বড় ভাই, আবার দাদু বা শ্রদ্ধাসূচক সম্বোধন। পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর অর্থ আবার ভিন্ন। আরবিতে এরকমই একটা শব্দ হলো ‘ইনশাআল্লাহ,’ যার মানে শুধু ‘আল্লাহ চাইলে’ নয়—এটা বিনয়, আশা আর বিশ্বাসের প্রতীক। একটি সার্বভৌম ভাষার মডেল এসব সূক্ষ্ম বিষয় বুঝতে সক্ষম হবে এবং ব্যবহারকারীকে যথাযথ সহায়তা প্রদান করতে পারবে।
সাইফুল এবং তাঁর দলের তৈরি আল্লাম এ বিষয়ে একটি বিপ্লব ঘটিয়েছে। আল্লাম শুধু আরবির ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয় বোঝে না, বরং প্রাসঙ্গিক উত্তর দিতে সক্ষম। মজার ব্যাপার হলো, সাইফুল বাংলা এবং ইংরেজিভাষী। আরবির কিছুই জানেন না! কিন্তু তাতে কী! ট্রান্সফার লার্নিং আর তার দুর্দান্ত বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে তিনি এমন কিছু করলেন, যেটা দেখে পুরো টিম আবার উঠে দাঁড়াল।
আজ আল্লাম শুধু আইবিএম ওয়াটসনক্স (IBM Watsonx) এবং মাইক্রোসফট আজুরেই (Microsoft Azure) নয়, বরং সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যে এআই গবেষণায় নতুন আলো দেখাচ্ছে। আর সাইফুল? সম্প্রতি এমআইটি টেক রিভিউ জার্নালের বার্ষিক মধ্যপ্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ ৩৫ উদ্ভাবকের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিক না হয়ে ৩৫ জনের তালিকায় শুধু সাইফুল এবং আরেকজন উদ্ভাবক (রুশ) জায়গা পেয়েছেন । মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য এটি বিরল সম্মান এবং অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক সংবাদ।