গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। একাধিক রাজনৈতিক দল, দলের আদর্শে বিশ্বাসী হাজার হাজার লাখ লাখ কর্মী সমর্থক, পক্ষে বিপক্ষে কর্মসূচি, মিছিল মিটিং জনসভা এসব যেন গণতান্ত্রিক চর্চার সৌন্দর্যের অংশ। কিন্তু এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতা দখলের লড়াই কিংবা প্রতিহিংসার বশে রাজনৈতিক শিষ্টাচার ভুলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মারামারি হানাহানি কিংবা সংঘর্ষে জড়ানোটা বাংলাদেশে অচেনা কিছু নয়, অচেনা নয় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দাপট বাড়তে থাকে ছাত্রলীগের। সেখান থেকে শুরু করে গত ১৫ বছরের বেশি সময়ে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে পতনের আগ পর্যন্ত এই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয়েছেন ২৬৮ জনের অধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। সংখ্যাটি কোনোভাবেই কম নয়, হামলার শিকার শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক-বর্তমান ছাত্রনেতা ও শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে দাপট বাড়তে থাকে ছাত্রলীগের। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে হামলা, নির্যাতন চালাতে থাকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। ২০০৯ সালের ২৩ জুন সকাল ১১টার দিকে মিছিল শেষে বাদানুবাদ থেকে সংঘর্ষে জড়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। এঘটনায় ছাত্রশিবিরের ৫ নেতাকর্মী আহত হন। পরের বছর ২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষে শাখা ছাত্রশিবির সভাপতিসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়। ২০১১ সালের ৪ জুলাই ছাত্রদলের সাথে সংঘর্ষে জড়ায় ইবি ছাত্রলীগ। এতে অন্তত ১৭ জন আহত হয় এবং এ সময় বিশ্বদ্যিালয়ের চারটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের ডাইনিং ম্যানেজার নিয়োগকে কেন্দ্র করে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর সংঘর্ষে জড়ায় দুই দল। পরে শিবিরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে ছাত্রলীগ কর্মীরা। এতে অন্তত ৩৫ জন আহত হন।
জানা যায়, ২০১২ সালের ১৯ নভেম্বর উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই দিন বেলা ১১টায় প্রশাসন ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে হামলা চালানো হয়। এরপর ২০১৩ সালের ১২ জানুয়ারি আবারো ইবি শিক্ষকদের ব্যাপক পেটায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ আহত হন কমপক্ষে ৪৫ জন শিক্ষক। শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ১৭ জানুয়ারি আইন অনুষদের সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে ছাত্রদল। উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায় এবং তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৩৫ জন আহত হন। ২০১১ সালের ১৪ আগস্ট লালন শাহ হল ও জিয়াউর রহমান হলে লুটপাটের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রদের ক্ষতিপূরণসহ সাত দফা দাবিতে ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ দুপুরে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেন ছাত্রশিবির নেতাকর্মীরা। উপাচার্যের কার্যালয় থেকে বের হয়ে অনুষদ ভবনের সামনে আসলে ছাত্রলীগ তাদের উপর হামলা চালায়। এ ঘটনায় ৩০ জন আহত হয়। ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগ ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করে। এতে অন্তত ২৫ জন আহত হন।
একই সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য মুক্তবাংলায় ফুল দেওয়ার সময় ছাত্রদল ও শিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারীসহ ১৩ জন আহত হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে ৩ জন আহত হন। ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ হয়। এতে ছাত্রদলের দুই কর্মী আহত হন। ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের দফায়-দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৩০ জন আহত হন। অপরদিকে সভাপতি-সম্পাদক গ্রুপের কর্মীরা প্রধান ফটক এলাকায় অবস্থান নিলে বেলা ১১টায় ট্রেন্ট থেকে নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে ফটকের দিকে গেলে দু’গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এতে চার জন আহত হন। জুনিয়র কর্তৃক সিনিয়রকে মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ৮ জন আহত হয়। শোক দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা শেষে ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট শাখা ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুইজন গুরুতরসহ অন্তত পাঁচজন আহত হয়।
শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম রাশেদ বলেন, বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ক্যাম্পাসে কোন ধরনের সহাবস্থান ছিল না। যারা ক্যাম্পাসে থাকার চেষ্টা করেছি তাদের কারণে অকারণে হামলা নির্যাতন করা হয়েছে, হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, তুচ্ছ কারণে মারধর করেছে।
‘‘আমি ২০১০ থেকে একটা লম্বা সময় ছাত্রদলের সেক্রেটারি থাকাকালীন ৩ ডজন মামলার আসামি হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পর্যন্ত বাদী হয়ে আমাদের নামে মামলা দিয়েছে। আমরা ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চাই, শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনার পরিবেশ পায়, নিরাপদে থাকে। মেধাবীদের নিয়ে আগামী দিনে ছাত্রদলের নেতৃত্ব আসবে, তারা ক্যাম্পাসে সহাবস্থান এবং পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিতে কাজ করে যাবে।’’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইবি শাখার সহ-সমন্বয়ক নাহিদ হাসান বলেন, গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাক্ষী হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত ১৫ বছর ধরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপকর্মে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে যে, জাতীয় রাজনৈতিক দলের স্বার্থে পরিচালিত ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে কাজ করলেও, ছাত্রলীগ কার্যত একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো আচরণ করে গুম, খুন, চাঁদাবাজি এবং নারী কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মতো অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল।
‘‘এই প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে একটি ‘I hate politics’ ধারা গড়ে তুলেছে। ভবিষ্যতে ছাত্ররাজনীতি থাকলেও তা শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা এবং নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। ছাত্র সংসদ পুনরায় চালু করে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব সৃষ্টির পথ সুগম করা এখন সময়ের দাবি।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান বলেন, ইতিমধ্যে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তাদেরকে কেউ যদি কোন ভাবে সহযোগিতা করার চিন্তাও করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। এরপরেও যদি কেউ সুনির্দিষ্ট কোন বিষয়ে অভিযোগ পত্র দাখিল করে তাহলে প্রশাসন অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।