চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ডিপসিকের তৈরি করা নতুন এআই ভাষা মডেল ‘ডিপসিক আরওয়ান’ প্রযুক্তি সারা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে চালু হওয়া এই সিস্টেম ইতিমধ্যে অ্যাপ ডাউনলোডের শীর্ষ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এই প্রযুক্তি শেয়ারবাজারে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের ধস নামিয়েছে এবং সিলিকন ভ্যালিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।
সোজা কথায় বললে, ডিপসিক আরওয়ান হলো এমন একটি এআই–ব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক এআই মডেলগুলোর সমকক্ষ, অথচ তুলনামূলক অনেক কম খরচে তৈরি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো এত দিন ধরে এআই গবেষণায় শীর্ষে ছিল। কিন্তু চীনের হাতে প্রযুক্তি–দুনিয়ার নেতৃত্ব চলে যেতে পারে—এ ভাবনায় পশ্চিমা দেশগুলো অস্থির হয়ে পড়েছে। যাঁরা নিবিড়ভাবে এআই নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের জন্য ডিপসিক আরওয়ান খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, এটি হুট করে আবির্ভূত হয়নি।
২০২৩ সালে চীনের ‘হাই-ফ্লাইয়ার’ নামে একটি হেজ ফান্ড (অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান) ডিপসিক প্রতিষ্ঠা করে। হাই-ফ্লাইয়ার মূলত বড় ডেটা বিশ্লেষণ করে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডিপসিকের গবেষণা ল্যাব দ্রুতই নতুন নতুন উদ্ভাবনী গবেষণা প্রকাশ করতে শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী লিয়াং ওয়েনফেং গত নভেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁদের কাজের উদ্দেশ্য শুধু ব্যবসায়িক লাভ নয়, বরং ‘উৎসাহ ও কৌতূহল’ থেকে তাঁরা এটি করছেন।
গত বছরের ডিসেম্বরেই তাঁরা ডিপসিক ভিথ্রি নামের একটি এআই মডেল চালু করেন। ভিথ্রি হলো আরওয়ানের আগের সংস্করণ। এটি একইভাবে উচ্চ কার্যক্ষমতাসম্পন্ন ও কম খরচের মডেল ছিল। এটি চ্যাটজিপিটির মতোই বড় ভাষা মডেল (এলএলএম)। এটি লেখালেখি, অনুবাদ, কোডিংসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়।
বিশ্বখ্যাত এআই–গবেষক আন্দ্রেই কারপ্যাথি গত বছর ডিপসিকের সক্ষমতা দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘অল্প বাজেটে বিশ্বমানের এআই মডেল তৈরি করে ডিপসিক আজ সহজেই দারুণ কিছু করে দেখাল।’ তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন ডিপসিক ভিথ্রি চালুর সময়।
ডিপসিক ভিথ্রি এবং আরওয়ান তৈরি করতে ডিপসিকের মোট খরচ হয়েছিল মাত্র ৬০ লাখ ডলার। যদিও এটি ছোট অঙ্ক নয়, কিন্তু ওপেনএআইয়ের জিপিটি-ফোরের সঙ্গে তুলনা করলে পার্থক্যটা বিশাল হয়ে ওঠে। কারণ, জিপিটি-ফোর তৈরি করতে ১০ কোটি ডলারের বেশি খরচ হয়েছিল। অর্থাৎ জিপিটি-ফোরের বাজেট ছিল ডিপসিকের বাজেটের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
আরওয়ানের প্রভাব এত বেশি হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
প্রথমত, আরওয়ান একটি ‘চেইন অব থট’ মডেল। এর মানে হলো এটি যখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়, তখন ধাপে ধাপে যুক্তি সাজিয়ে ব্যাখ্যা করতে থাকে, ঠিক যেমন একজন মানুষ চিন্তা করে এবং উত্তর তৈরি করে। সাধারণ এআই মডেলগুলো শুধু ডেটাবেজ থেকে তথ্য টেনে এনে উত্তর দেয়। কিন্তু আরওয়ান নিজের ভাবনাকে সাজিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে। ফলে এর উত্তরগুলো বেশি নির্ভরযোগ্য ও বোধগম্য হয়।
এ কারণেই আরওয়ানের সক্ষমতাকে ওপেনএআইয়ের ওওয়ান মডেলের সমতুল্য বলে ধরা হচ্ছে। জিরোওয়ানও একই ধরনের চেইন অব থট পদ্ধতি ব্যবহার করে।
এ দুই মডেলের পারফরম্যান্স প্রায় একই পর্যায়ে রয়েছে। তবে আরওয়ানের আরেকটি বিশেষত্ব হলো এটি বিশেষ করে গণিত ও প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষেত্রে দারুণ পারফর্ম করছে। সাধারণত, এআই মডেলগুলো ভাষাগত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেও জটিল গাণিতিক বা কোডিং–সম্পর্কিত প্রশ্নে খুব একটা ভালো করতে পারে না। কিন্তু আরওয়ান সেই দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে পেরেছে।
আরেকটি বড় কারণ হলো, আরওয়ান সহজে ব্যবহার করা যায় এবং একদম বিনা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। ওপেনএআইয়ের ওওয়ান মডেল ব্যবহার করতে মাসে ২০ ডলার খরচ করতে হয়। কিন্তু আরওয়ানের অ্যাপ একেবারে ফ্রি। শুধু সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্যই নয়, ডেভেলপারদের জন্যও এটি পুরোপুরি ফ্রি। তাঁরা চাইলে আরওয়ানের কোড ডাউনলোড করে নিজেদের ব্যবসা বা প্রকল্পে ব্যবহার করতে পারেন, যেখানে অন্যান্য উন্নত এআই মডেলগুলো সাধারণত অর্থের বিনিময়ে পাওয়া যায়।
এই সহজলভ্যতাই আরওয়ানের জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আরওয়ান তৈরির পদ্ধতি সিলিকন ভ্যালির প্রচলিত এআই উন্নয়নের কৌশলকে চ্যালেঞ্জ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত বড় এআই মডেল তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ তথ্য ও শক্তিশালী কম্পিউটার ব্যবহার করে। এতে বিশাল পরিমাণ শক্তি ও অর্থ খরচ হয়, যা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিকভাবে নির্ভরশীল করে তুলছে। যেমন সম্প্রতি ট্রাম্প ৫০০ বিলিয়ন ডলারের ‘স্টারগেট’ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে সেখানে সরকার এআই উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।
কিন্তু আরওয়ান প্রমাণ করেছে, কম খরচে ও কম শক্তি ব্যবহার করেও উন্নত মানের এআই তৈরি করা সম্ভব। এটি ওপেনএআইয়ের ওওয়ানের তুলনায় ৯৫ শতাংশ সস্তা এবং মেটার এললামা থ্রি পয়েন্ট ওয়ানের মাত্র এক-দশমাংশ কম্পিউটিং শক্তি ব্যবহার করে। এত কম বাজেটে উন্নত পারফরম্যান্সের এআই তৈরি করা সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার, যা যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচুর টাকা খরচের পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
তবে আরওয়ানের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখনই বোঝা কঠিন। কেউ বলছেন, এটি এনভিডিয়ার মতো চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজারমূল্য বেশি ধরে নেওয়া হয়েছে বলে প্রমাণ করছে।
সব মিলিয়ে এটি স্পষ্ট, এআই–জগৎ খুবই অস্থির এবং এটি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। ডিপসিক আরওয়ান এআই–জগৎকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।