ক্লাস-পরীক্ষায় না থেকেও বেতন নিচ্ছেন জবি শিক্ষক-কর্মকর্তারা


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত মাসের অধিক সময় অফিস না করেও বেতন ভাতা নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এদের মধ্যে অধিকাংশই জুলাই আন্দোলনে বিরোধিতা করায় আগস্টের পর থেকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্লাস পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পরে নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুননাহার লিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। জুলাই আন্দোলনের বিরোধিতা করায় বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাকে বয়কটের ডাক দেয়। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত বেতন ভাতা পাচ্ছেন। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছিলেন, ‘জাতির পিতাকে ভালোবেসে যদি চাকরি যায়, তবে তাই হোক’।

এমন আরেক শিক্ষক হলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু সালেহ সেকেন্দার। তাকে ৫ আগস্টের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাময়িক বহিষ্কার করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বেতন-ভাতা বন্ধ করা হয়নি। ফ্যাসিবাদি হাসিনার পতনের পরে ছাত্রলীগকে বয়কট করা হলে এটাকে ইতিহাসের সব থেকে বড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত বলে তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেন এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের পক্ষ নিয়ে কলাম লেখেন।

এ তালিকায় আরও আছেন বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস। আওয়ামী লীগের এমপি মন্ত্রীদের আস্থাভাজন এ শিক্ষক জুলাই আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং ছাত্রদের বিরোধিতা করে কলাম লেখেন। ফলে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাসকে শিক্ষার্থীরা বয়কট করেন এবং তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। অথচ এখন পর্যন্ত বাংলা বিভাগের এ শিক্ষকের বেতন-ভাতা বহাল রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার বেতন ভাতাও এখন পর্যন্ত বন্ধ করেননি।

বাংলা বিভাগের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ড. ফেরদৌসী খাতুন। নিয়মিত কর্মস্থলে এলেও চার বছর ধরে কোন ক্লাস ও পরীক্ষার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। এরপরেও বেতন-ভাতা গ্রহণ করে আসছেন।

এ বিষয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোজাহারুল আলম সেলিম বলেন, ফেরদৌসী খাতুন চার বছর ধরে কোন প্রকার ক্লাস বা পরীক্ষার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত নেই। একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ক্লাসে অংশগ্রহণ করেন না এবং তিনি কি কারণে তিনি ক্লাস নেন না সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানে না।

এদিকে জুলাই আন্দোলনে ছাত্রদের বিরোধিতা করায় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছয় জন শিক্ষকের ক্লাস পরীক্ষা থেকে বয়কট করেছেন শিক্ষার্থীরা। তারা হলেন-অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল, অধ্যাপক ডক্টর আব্দুল ওদুদ, অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক ডক্টর মো. নজরুল ইসলাম, সহকারী অধ্যাপক মোবারক হোসেন এবং সহকারি অধ্যাপক এ জি এম সাদিদ জাহান। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের পরে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা এই ছয়জন শিক্ষককে বয়কটের দাবি তোলেন এবং বিভাগীয় ভবনের সামনে তাদের ছবিতে জুতা নিক্ষেপ করেন। এদের মধ্যে শুধু অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামালের বেতন বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করলেও বাকিদের বেতন ভাতা এখনো পর্যন্ত বহাল রয়েছে।

উল্লেখ্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামাল জুলাই গণঅভ্যুত্থান এর পর থেকে কর্মস্থলে আসেন না। অভিযোগ আছে যে, তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে পিএইচডি সনদ নিয়েছিলেন। তার সময়ে জবি প্রক্টর অফিসকে ‘জবির টর্সারসেল’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তিনি প্রক্টর থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের তুচ্ছ ঘটনায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, মাদক অভিযানের নামে হয়রানি, সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাসে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে দেখলে ডেকে নিয়ে বিয়ে দিতে চাওয়া, রাজনৈতিক হয়রানিসহ বিভিন্ন ঘটনায় মানসিকভাবে হেয় করার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি রিকশাচালকসহ বাইরের লোকজনকেও অত্যাচার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকার আত্মহত্যায়ও তার সংযুক্তি আছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া মার্কেটিং বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জহির উদ্দিন আরিফ ৫ আগস্টের পর থেকে আর কর্মস্থলে আসেন না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাকে বিভাগ থেকে বয়কটের দাবি জানিয়ে ক্যাম্পাসের শান্ত চত্বরে মানববন্ধন করে। যার ফলশ্রুতিতে তিনি ৫ আগস্টের পর থেকে ক্লাস ও পরীক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত নেই। অথচ তিনিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বেতন-ভাতা এখনো গ্রহণ করে চলেছেন।

এছাড়া এই তালিকায় আছেন ৪ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তাও। তারা হলেন- ডেপুটি রেজিস্ট্রার জিনাত জেরিনা সুলতানা, অর্থ ও হিসাব দপ্তরের সহকারি পরিচালক সালাউদ্দিন মোল্লা, ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্দুল কাদের ওরফে কাজী মনির ও একজন স্টোর কিপার।

জানা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ডেপুটি রেজিস্টার আব্দুল কাদের ওরফে কাজী মনির জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে আর ক্যাম্পাসে আসেন না। পলাতক থেকে কর্মস্থলে না এসেও সে এতদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন ভাতা গ্রহণ করেছেন, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুমাস আগে তার বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিয়েছেন।

অর্থ ও হিসাব দপ্তরের সহকারী পরিচালক সালাউদ্দিন মোল্লাও ৫ আগস্টের পর আত্মগোপন করে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থান করছেন। অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থান করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল হককে গুলি করে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন তিনি। এর প্রেক্ষিতে তার নামে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। তার বেতন ভাতাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুমাস হল বন্ধ করে দিয়েছেন।

ডেপুটি রেজিস্ট্রার জিনাত জেরিনা সুলতানা ২০১৭ সালের পর থেকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি। বিশ্ববিদ্যালয় না এসেও তিনি এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে নিয়মিত বেতন ভাতা নিয়েছেন। কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন ভাতা বাবদ ৬০ লাখের বেশি টাকা নিয়েছেন এই কর্মকর্তা। তার বেতনও দুমাস আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বন্ধ করেছেন।

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জবি প্রশাসনের গড়িমসি :


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই অভিযোগে ঢাবি, জাবি ও চুয়েট প্রশাসন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বহিষ্কার করলেও জবি প্রশাসন চায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। ভিডিও ফুটেজ থেকে সেসময়ে ছাত্রলীগের হামলায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করা গেলেও প্রশাসন বলছে তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ নেই। এমনকি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিরোধিতাকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিচারে গঠিত হওয়া কমিটির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ।

গতবছরের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন জবি ছাত্রলীগের ইব্রাহিম-আকতারের নেতৃত্বে একাধিক দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় অংশ নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এদিকে বিচার কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালরে ছাত্র সংগঠনগুলোও। এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি আসাদুল ইসলাম বলেন, আমরা বারবার প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এই অপরাধীদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল বলেন, আমরা ইতোমধ্যে প্রশাসনকে জানিয়েছি এবং ‘মার্চ ফর জাস্টিস’—এর মাধ্যমে স্মারকলিপি জমা দিয়েছি। ক্যাম্পাসে জোরপূর্বক গুম, খুন, চাঁদাবাজি ও নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত এবং স্বৈরাচারের প্রত্যক্ষ—পরোক্ষভাবে সহযোগিতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জবি ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি একেএম রাকিব বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর যেভাবে আক্রমণ করেছিল, সরকার গঠনের এক মাসের মধ্যে তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের আশ্রয় দিচ্ছে এবং পড়াশোনা ও পরীক্ষা চালিয়ে যেতে দিচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তবে প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ হলে সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রত্যেক দপ্তর প্রধানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রত্যেকটা দপ্তর প্রধানকে চিঠি দিয়েছিলাম। যে সব ডিপার্টমেন্ট থেকে আমরা শিক্ষকদের অনুপস্থিতির তালিকা পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু করেছি।

Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.