কোডের জাদু আমায় মুগ্ধ করে, অতপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসে ডাক


মুমতাহিনা করিম মীম
: আমি তখন কেবল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, যখন প্রোগ্রামিং সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। কোডের জাদু আমায় মুগ্ধ করেছিল। কীভাবে কেবল কয়েকটি লাইন লিখেই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়! সপ্তম শ্রেণিতে থাকতে আমি আমার স্কুলের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করি।

তখন আমাদের স্কুলে কোনো ওয়েবসাইট ছিল না। এরপর ধাপে ধাপে যোগ দিই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায়, একের পর এক পুরস্কার জিতে নিই, অংশগ্রহণ করি বিভিন্ন ওপেন সোর্স প্রজেক্টে।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আমারে জন্ম এবং বন্দর নগরীতে বেড়ে ওঠা আমার। পথচলাটা সহজ ছিল না। একজন মেয়ে হয়ে প্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করাটা ছিল চ্যালেঞ্জিং। অনেকেই বলতো, ‘এগুলো ছেলেদের জন্য।’ আবার কেউ কেউ সন্দেহ করতো আমার দক্ষতা নিয়ে।

৯ম শ্রেণিতে আমি স্কুলে একটি প্রোগ্রামিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করি, যেখানে শুরুতে ৬৫ জন সদস্য ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা আরও বড় হতে থাকে। আমি নিজে হাতে শিক্ষার্থীদের কোডিং শিখিয়েছি এবং আমার নেতৃত্বে আমাদের দল জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করে।

কিন্তু চারপাশের মানুষজন বলতো, ‘এগুলো মেয়েদের জন্য নয়, এসব শিখে কী হবে?’ আমার নিজের শিক্ষকরাও ব্যতিক্রম ছিলেন না।

স্কুলে থাকাকালীন প্রোগ্রামিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। আমার ক্লাসের গণিত শিক্ষক বলেছিলেন, ‘তুমি হচ্ছো ফুটো বালতি, আমাদের তোমার এই কোডিংয়ের কোনো দরকার নেই। এটা পুরোপুরি অকাজের!’

তিনি এতটাই বিরোধিতা করেছিলেন যে একদিন আমাকে চাপ দিয়ে প্রধান শিক্ষিকার রুমে নিয়ে গিয়ে স্কুল থেকে বহিষ্কার করার পরিকল্পনা করলেন। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম, যেন আমার স্বপ্নগুলো এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, প্রধান শিক্ষিকা লিলি বড়ুয়া বললেন, ‘আমি তোমার চোখে বড় স্বপ্ন দেখছি। তোমার ক্লাস শিক্ষক তোমার স্বপ্ন ধ্বংস করতে চায়, কিন্তু আমি তা হতে দেব না। তুমি ভবিষ্যতে অনেক বড় কিছু করবে।’

প্রোগ্রামিংয়ের বাইরেও আমার আগ্রহ ছড়িয়ে পড়েছিল নানা দিকে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় ইউটিউব দেখে রোবটিক্স শেখা শুরু করি। নিজের হাতে বানিয়েছিলাম একটি আরসি রোবট, যা খাবার পরিবেশন করতে পারতো, একটি স্মার্ট ডাস্টবিন, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বর্জ্য সংগ্রহ করতো, আর এমন কিছু রোবট যা নির্দিষ্ট সংকেত পেলে হাত নাড়াতে পারতো।

কোডিংয়ের পাশাপাশি আমি শিল্প, সাহিত্য, বিতর্ক, সংগীত— সবকিছুতেই গভীরভাবে জড়িত ছিলাম। আমার আঁকা স্কেচ জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, আমার লেখা রচনা আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছে, আমি ইউনিসেফ বাংলাদেশে শিশু অধিকার নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছি।

এমনকি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সচেতনতা তৈরি করতে ‘কোর্ডিয়াল টু আর্থ’ নামে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি, যা বন্যাকবলিত মানুষের সাহায্যে এক লাখ টাকা সংগ্রহ করেছিল এবং সেই সাথে একটি পরিবেশবান্ধব অ্যাপ তৈরি করেছিলাম।

এত কিছুর পরেও চ্যালেঞ্জ শেষ হয়নি। স্কুল শেষ করে যখন কলেজে গেলাম, তখন নতুন পরিবেশ, নতুন চাপ সবকিছু মিলিয়ে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুদিন পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারিনি, ফলাফলে প্রভাব পড়েছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে আবার স্বপ্নের পথে ফিরেছি।

এরপর শুরু হলো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার যুদ্ধ। আত্মীয়-স্বজনরা বলেছিল, ‘তোমার তো কোনো স্কলারশিপই হবে না। শুধু সময় নষ্ট করছ!’ আবার অনেকে আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নেয়ার ব্যাপরাটায় হেসে উড়িয়ে দিতো। আমার স্যাট, আইইএলটিএস পরীক্ষা, রিকমেন্ডেশন লেটার প্রত্যেকটি ধাপ ছিল পরিশ্রমের পরীক্ষা।
কিন্তু আমি জানতাম, আমার গল্পটাই আমার শক্তি। আমি আমার অ্যাপ্লিকেশনে সেই সংগ্রামের কথা লিখেছি, সেই অনুপ্রেরণার কথা লিখেছি, যা আমাকে একদিন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

অবশেষে যখন অফার আসতে শুরু করল, তখন বুঝলাম যে আমার পরিশ্রম বৃথা যায়নি। আমি ২০টিরও বেশি শীর্ষ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার পেয়েছি। যার মধ্যে রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো, ফ্রাঙ্কলিন অ্যান্ড মার্শাল কলেজ, হোবার্ট অ্যান্ড উইলিয়াম স্মিথ কলেজ, ক্লেমসন ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি।

শেষমেশ একদিন ই-মেইল পেলাম হেনড্রিক্স কলেজ থেকে, হ্যাস মেমোরিয়াল বৃত্তির ফাইনালিস্ট হিসেবে আমি নির্বাচিত হয়েছি, যা প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে মাত্র চারজনকে দেয়া হয়! ডাক পড়ে ইন্টারভিউয়ের।

চলতি মাসের ৩ তারিখ জানতে পারলাম আমি এই বৃত্তির জন্য মনোনীত হলাম। আমি বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাক্তি যে এই সম্মান অর্জন করেছে।

এই পুরো যাত্রায় আমি একটা জিনিস বুঝেছি— স্বপ্ন কখনও বড় বা ছোট হয় না। যত চ্যালেঞ্জই আসুক, যদি মনোবল দৃঢ় থাকে, পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে, তবে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। যদি লেগে থাকা যায়, যদি বিশ্বাস রাখা যায়, তাহলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে উঠে এসে যে কেউ সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে পারে।

Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.