ভুয়া সনদে চাকরি করছেন কুবি শিক্ষক!


কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) মার্কেটিং বিভাগে বিতর্কিতভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক আবু ওবায়দা রাহিদের বিরুদ্ধে এবার নিয়োগের সময় ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে শিক্ষক হওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। নিয়োগের সময় কুমিল্লার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার সনদ প্রদর্শন করেছিলেন তিনি। যদিও অনুসন্ধানে এর সত্যতা মেলেনি। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের সময় আবু ওবায়দা রাহিদ সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা সনদ প্রদর্শন করেন। অভিজ্ঞতা সনদের একটি কপি এ প্রতিবেদকের সংরক্ষণে রয়েছে। তিনি বেসরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়টির বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বলে সনদে উল্লেখ করা হয়। সিসিএন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

সিসিএনের অন্তত ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ এক নেতা ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মঈন এই অভিজ্ঞতা সনদের জন্য সিসিএন কর্তৃপক্ষকে চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। এ সনদের জন্য আর্থিক লেনদেনও হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।

সিসিএনে কর্মরত একজন সিনিয়র শিক্ষক এ প্রতিবেদককে বলেন, রাহিদ এডহকে সম্ভবত কিছুদিন সিসিএনে কর্মরত ছিল। কিন্তু সেটা কয়েক মাস হবে। ছয় বছর তো কোনোভাবেই নয়। তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের শীর্ষ এক নেতা ও কুবির সাবেক উপাচার্যের চাপ প্রয়োগের কারণে অভিজ্ঞতা সনদ দিতে সিসিএনকে বাধ্য করা হয়েছিল।

সিসিএনের আরেক শিক্ষক বলেন, এখানে বিরাট একটা অর্থের লেনদেন হয়েছে সিসিএনের সঙ্গে। যার কারণে সিসিএন এই ইস্যুটা এড়িয়ে যাচ্ছে।

চাকরির নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। 

সিসিএনে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগের যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ সালের শেষার্ধে। এরপর ভর্তি হওয়া কয়েকটি ব্যাচের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা আবু ওবায়দা রাহিদ নামে কোনো শিক্ষককে এ বিভাগে ক্লাস নিতে দেখেননি। 

এ বিভাগের ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আহমেদ শাফি বলেন, রাহিদ নামের কোনো শিক্ষক আমাদের সময় ছিল না। আমি ২০২১ সালে বের হয়েছি এর মধ্যে এই নামে কেউ থাকলে একদিন হলেও তো দেখা হতো। বিবিএতে পার্ট টাইম, ফুল টাইম কখনোই এই নামে কেউ ছিল না।

২০১৮ শিক্ষাবর্ষের সাকিব নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এই নামের কোনো শিক্ষক যদি আমাদের ক্লাস নিতেন তাহলে তো আমরা চিনতাম। আমি আমাদের ব্যাচের গ্রুপেও মেসেজ দিয়েছি কিন্তু কেউই তাকে চিনে না।

রাহিদের ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদের বিষয়ে জানতে সিসিএন প্রশাসন ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। তারা বারবার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। 

সিসিএনের মানবসম্পদ কর্মকর্তা নয়ন চন্দ্র গত ৬ জানুয়ারি এ বিষয়ে বলেন, উনাকে (রাহিদ) ২০১৯ সালের দিকে করোনার সময় এখানে কিছুদিন দেখেছি। এরপর আর দেখিনি।

একই দিন চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, উনি ২০১৯ সালে এডহোক হিসেবে দুই এক মাস জব করেছে। এরপর আর কিছু না বলে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।

এরপর আবার ১২ জানুয়ারি যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, উনি আমাদের এখানে ২০১৬ সাল থেকে ছিল। তবে এর পক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। 

এ সময় স্যালারি স্টেটমেন্ট দেখাতে বললে তিনি বলেন, তখন তো বেতনই দিতে পারতাম না শিক্ষকদের। ডেকে ডেকে তাদেরকে অনুরোধ করে ক্লাস নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হতো।

বেতন না দিলে স্থায়ী হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কী করব। বিশ্ববিদ্যালয় তো চালাতে হবে। এই জন্য স্থায়ী হয়ে গেছে।

জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি যোগ্যতার শর্ত পূরণ না করলেও আবু ওবায়দা রাহিদকে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেন তৎকালীন আওয়ামী সমর্থিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মঈন। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের শিক্ষক নিয়োগের বিধিমালা অনুযায়ী চাকরিপ্রার্থীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল ন্যূনতম ৩ দশমিক ৭০ হতে হবে। তবে আবু ওবায়দা রাহিদকে মার্কেটিং বিভাগে নিয়োগ দিতে অভিনব উপায়ে অননুমোদিত একটি বিধি যোগ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তৎকালীন উপাচার্য আব্দুল মঈন। ওই বিধিতে এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী অথবা শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলে ফলাফলের যোগ্যতায় শিথিলতার কথা বলা হয়। যদিও সে সময় এ বিধিটিও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদিত ছিল না। রাহিদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফল ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৫৬ ও ৩ দশমিক ৫৪। ফলাফল কম থাকার পরও এ বিধির আলোকে সিসিএনে শিক্ষকতার ‘ভুয়া’ অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে নিয়োগ ভাগিয়ে নেন তিনি।

সে সময় বিষয়গুলো নিয়ে তৎকালীন উপাচার্য আব্দুল মঈন বলেছিলেন, গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই ওই বিধিটি যুক্ত করা হয়েছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিধিমালার শর্ত পূরণ না করায় বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির আবেদন বাছাই প্রক্রিয়াতেই বাদ পড়ে যান আবু ওবায়দা রাহিদ। তৎকালীন কমিটি রাহিদকে বাদ দিয়ে আবেদনকৃত বাকি ২২ জনের তালিকা রেজিস্ট্রার দপ্তরে পাঠায়। তবে তৎকালীন রেজিস্ট্রার উপাচার্যের নির্দেশে আইন লঙ্ঘন করে বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশ করা তালিকায় নিজ থেকে রাহিদসহ আরো দুজনের নাম যুক্ত করেন। বিষয়টি নিয়ে সে সময় শিক্ষকদের পক্ষ থেকে চিঠি ও আইনি নোটিশ দেওয়া হলেও তা আমলে নেননি তৎকালীন উপাচার্য। এমনকি রাহিদের লিখিত পরীক্ষার খাতায় বিশেষ শনাক্তকরণ চিহ্নও পাওয়া গিয়েছিল। ভাইবা বোর্ডেও এক শিক্ষক তার বিষয়ে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানান। শেষ পর্যন্ত তাকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন উপাচার্য আব্দুল মঈন।
নবীনতর পূর্বতন