শিক্ষার্থীদের ঈদ আনন্দ স্মৃতি বাস্তবতা


সাম্য, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে আবার আমাদের মাঝে আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। একটি বছর অপেক্ষার পর এই আনন্দঘন উৎসব ফিরে আসে, নিয়ে আসে নতুন আলো, নতুন আশা। রমজানের এক মাসের সিয়াম সাধনার পর ঈদ শুধু আনন্দের নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, আত্মীয়তা ও ভালোবাসার এক অনন্য উৎসব। তবে এই ঈদের আনন্দ সবার জন্য এক রকম নয়। ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই ছুটে গেছেন প্রিয়জনদের কাছে, ফিরে গেছেন শৈশবের সেই চেনা উঠানে, যেখানে ঈদের সকাল মানেই বাবা-মায়ের আদর, মিষ্টি সেমাইয়ের ঘ্রাণ আর নতুন পোশাকের উচ্ছ্বাস। কিন্তু এরই মাঝে অনেক শিক্ষার্থী এখনও রয়ে গেছেন ক্যাম্পাসের আবাসিক হলে বা ভাড়া বাসায়, যাদের জন্য ঈদ মানে এক অন্যরকম অনুভূতিÑ একটু শূন্যতা, একটু অপেক্ষা, আর একটু বাড়তি স্মৃতিচারণা। শিক্ষার্থীরা তাদের ঈদ ভাবনা, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার গল্প জানিয়েছেন আমাদের সময়কে। তুলে ধরেছেন মো. মেহেরাব হোসেন রিফাত

রমজান মাসে বেশিরভাগ সময় হলেই কাটিয়েছি


খাইরুল আলম জীম
অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঈদ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অনন্য আনন্দ ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। ছোটবেলা থেকেই ঈদ বলতে বুঝি আনন্দ-উল্লাস-উদ্দীপনা। সারাবছর অপেক্ষা করে থাকতাম কবে এই ঈদ আসবে। তবে যতই বড় হয়েছি, ঈদ পরিণত হয়েছে কিছুটা উৎসাহ, কিছুটা স্বস্তি, আবার কিছুটা চিন্তায়ও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে এবারের রমজান মাসের দুই-তৃতীয়াংশ সময় বিশ্ববিদ্যালয় হলেই কাটিয়েছি। হলজীবনে কাটানো দিনগুলো শেষে পরিবারের টানেই ছুটে যাই বাড়ির পথে। আমার মতো অনেক শিক্ষার্থীই সারাবছর নানা ব্যস্ততায় শহরে থেকে যায়, তাই ঈদের ছুটি আমাদের কাছে এক বিশেষ অর্থ বহন করে। মিডটার্ম, অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা টার্ম পেপারের চাপ কাটিয়ে ঈদের ছুটি যেন এক অমূল্য সম্পদ আমাদের জন্য । পড়ার চাপ থাকলেও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে দেওয়া যায় না। টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে মা, বাবা, ভাইবোনের জন্য উপহার কিনে নিয়েছি এখান থেকেই। উপহারগুলো কেনার সময় বাজারের ভিড়ে বাবার হাত ধরে কেনাকাটা করার স্মৃতিগুলো যেন আবার নতুন করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঈদের দিন সকালবেলায় নামাজ পড়তে যাওয়া, বাড়ি ফিরে মজার মজার খাবার খেয়ে ঘুরতে বের হওয়া, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করা, এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। অমূল্য সম্পদ। তবে জীবনের ব্যস্ততায় আগের মতো আর হয়তো আনন্দ করে ঈদ উদ্‌যাপন করা যায় না। তবু চেষ্টা করি সব দুঃখ-বেদনা-হতাশা পাশে রেখে ঈদের এই মাহেন্দ্রক্ষণটি পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন নিয়ে উদ্‌যাপন করতে।

ঈদের খুশি ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে

মো. আরাফাত খান, ফার্মেসি বিভাগ, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

রমজানের দীর্ঘ এক মাসের সংযম ও ইবাদতের পর ঈদুল ফিতর আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। ঈদ মানেই খুশি, উচ্ছ্বাস, প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানো, ভালোবাসার বন্ধনকে আরও দৃঢ় করার উপলক্ষ। কিন্তু সত্যিই কি ঈদের আনন্দ সবার জন্য সমানভাবে আসে? ক্যাম্পাসে থাকা অনেকেরই মনে হয় কবে বাড়ি ফিরব, কবে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাব। কিন্তু নানা বাস্তবতা সবার সেই সুযোগ করে দেয় না। টিউশন, চাকরির প্রস্তুতি কিংবা অন্যান্য দায়িত্বের কারণে অনেকে ঈদেও প্রিয়জনদের কাছে যেতে পারে না। আবার কেউ কেউ বাবা-মা বা কাছের মানুষ হারানোর বেদনায় ঈদের আনন্দ ঠিকভাবে উপভোগ করতে পারে না। পরিবারের হাল ধরতে গিয়ে নিজের জন্য নতুন পোশাক না কেনার বাস্তবতা, ভালো খাবারের আক্ষেপ এ সবই অনেকের ঈদকে মলিন করে তোলে। তাই আমাদের উচিত ঈদের খুশি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। আশপাশের দুস্থ, অসহায় কিংবা স্বজনহারা মানুষের পাশে দাঁড়ানো, যাতে কেউ অনুভব না করে যে ঈদ তাদের জন্য নয়। ঈদ হোক সত্যিকারের সর্বজনীন উৎসব, যেখানে প্রতিটি মানুষ দীর্ঘ এক মাসের সংযমের পর আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারে।

জীবন যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার নাম

সুমাইয়া আক্তার মৌ, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

রমজানের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে প্রিয় মানুষদের ছেড়ে, একাকিত্ব আর ব্যস্ততায়। শৈশবের রমজানের স্মৃতি মনে পড়তেই চোখ ছলছল করে ওঠে পরিবারের সবাই মিলে ইফতার, সেহরি, হাসি-আনন্দে ভরা সময়। অথচ এখন বড় হয়ে জীবন যেন এক ভিন্ন বাস্তবতার নাম। ফোনের ওপাশে পরিবারের কাঁদো কাঁদো কণ্ঠ, উদ্বিগ্ন প্রশ্ন আমার সন্তান কেমন আছে? তার রোজার দিনগুলো কেমন কাটছে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে নিজেকেও প্রশ্ন করেছি, কেমন কেটেছে আমার রমজান? ক্লাস, পরীক্ষা, টিউশন আর নানা দায়িত্বের মাঝে একা একা রোজা রাখা আর নিজের খাবার নিজে রান্না করা মোটেও সহজ ছিল না। তবু মনের মধ্যে একটা শক্ত ভাবনা ছিল নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে, পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। এই ভাবনাই ছিল প্রেরণা, আর এভাবেই কেটেছে রমজানের দিনগুলো। তবুও প্রতিটি মুহূর্তে মায়ের হাতের রান্না আর পরিবারের সান্নিধ্য মিস করেছি। অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান। বহু অপেক্ষার পর ফিরলাম সেই আপন ঠিকানায় নিজের ঘর, পরিবার, শৈশবের সেই পরিচিত পরিবেশ। বাড়ির আঙিনায় পা দিতেই মন ভরে উঠল আনন্দে, ভালোবাসায়। কিন্তু জানি, এই সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। আবার ফিরতে হবে ব্যস্ততম জীবনে, ক্লাস, পরীক্ষা, কোলাহল আর দায়িত্বের চাপে ডুবে যেতে হবে। সময় কারও জন্য থেমে থাকে না, তাই আবারও ব্যস্ত জীবনের ছন্দে ফিরে যেতে হবে। তবু নীড়ে ফেরার এই অমূল্য মুহূর্তগুলো চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে হৃদয়ের গভীরে।

আত্মকেন্দ্রিক নয়, ঈদ হোক সবার জন্য

সুরাইয়া ইয়াসমিন সুমি

ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পরেই আসে খুশির ঈদ। ঈদ মানেই আনন্দ, খুশি। ঈদের এই আমেজ যেন ছড়িয়ে যায় চারদিকে। ঈদের দিনকে ঘিরে কত রকম ভাবনা থাকে! রোজার মাস আমাদের শেখায় ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে মানুষ ভাবতে। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকতে। ঈদে শুধু অভিজাত পোশাকের বিলাসিতা না করে শ্রেণিবৈষম্য ভুলে আর্তমানবতার পাশে দাঁড়ানো আমাদের উচিত। কত মানুষ আছে, ঈদের খুশি যেন তাদের কাছে উচ্চাকাক্সক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়! পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন কত অসহায় বাবা, মা, বোন, ভাই। আমাদের মনমানসিকতা এখন এমন হয়ে গেছে যে, কে কত পাল্লা দিয়ে একজনের চেয়ে বেশি কিনতে পারে, এ পোশাক সে পোশাক আরও কত কি! কিন্তু কখনও কি একটু ভেবেছি সে মানুষগুলোর কথা! ঈদ মানেই তো খুশি। আসুন, আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা থেকে বের হয়ে একটু তাদের কথা চিন্তা করি। ভালোবাসা, আন্তরিকতায় ঈদ ভাগাভাগি হোক তাদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক হোক সৌহার্দ্যপূর্ণ। তাদের মুখের এক চিলতে হাসির কারণ হই। এবারের ঈদ বয়ে আনুক অনাবিল শান্তি, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।

Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.