দেশের প্রথম ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পূর্বাভাসের সক্ষমতা বাড়াতে দেশের প্রথম ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে এই স্টেশন চীনের স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।

স্টেশনটি উপকূলীয় এলাকার বিস্তারিত তথ্য ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে, যা দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এটি সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চীনের জাতীয় সমুদ্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'সেকেন্ড ইন্সটিটিউট অব ওশানোগ্রাফি'র যৌথ উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান অনুষদে এই প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কারিগরি ও যান্ত্রিক সহায়তা দিচ্ছে চীনা প্রতিষ্ঠানটি।

চবি কর্তৃপক্ষ স্টেশনটির পরিচালনায় লোকবল, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গবেষকসহ অন্যান্য ইনকাইন্ড সেবা প্রদান করবে।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের সেকেন্ড ইন্সটিটিউট অব ওশানোগ্রাফির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর চলতি বছরের ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান অনুষদে দেশের প্রথম ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস পেতে বাংলাদেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ), জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার (জেটিডব্লিউসি) এবং ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (আইএমডি)–এর মতো বিদেশি সংস্থার স্যাটেলাইট তথ্যের ওপর নির্ভর করে।

এসব সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস দিতে ২০ থেকে ৩০ ঘণ্টা সময় লেগে যায়—যা সময়সাপেক্ষ এবং পরনির্ভরশীল একটি প্রক্রিয়া।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ২০৩৫ সালের মধ্যে আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ মেরিন ডেটা হাবে রূপান্তর এবং জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একটি রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ উদ্দেশ্যে 'এসজিএসএমআরএস ২০৩৫ মাস্টারপ্ল্যান' প্রণয়ন করা হচ্ছে, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সহায়তা করবে।

প্রকল্পটির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এসজিএসএমআরএস বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। বর্তমানে আমরা বিদেশি সংস্থার স্যাটেলাইট তথ্যের ওপর নির্ভরশীল, যা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এসজিএসএমআরএস প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের এইচওয়াই-১এসআই/ডি ও এফওয়াই-৪বি স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, বাতাসের গতি এবং মেঘের গতিবিধি বিশ্লেষণ করে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা আগেই সতর্কতা দেওয়া সম্ভব হবে।"

তিনি আরও বলেন, "এর ফলে দেশের নিজস্ব সংস্থার ওপর নির্ভরতা বাড়বে এবং স্থানীয়ভাবে তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা বাড়বে, যা পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে।"

চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেছেন, চলতি বছরের মধ্যেই নির্মাণ ও স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করে গ্রাউন্ড স্টেশনের কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

সমুদ্র অর্থনীতিতে সহায়ক

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেই চারটি ফিশিং জোন চিহ্নিত করা হয়েছিল। তবে এসব জোনে নিয়মিত মাছ ধরা হচ্ছে কি না—তা নিশ্চিত নয়। ২০১০ সালের পর বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা জয় করলেও ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন না থাকায় মৎস্যসম্পদসহ সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন গবেষকরা।

বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে সম্ভাব্য মাছ ধরার অঞ্চল (পটেনশিয়াল ফিলিশিং জোন) শনাক্ত করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাউন্ড স্টেশন চালু হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, স্রোতের গতি এবং ক্লোরোফিল ঘনত্বের মতো তথ্য নিয়মিতভাবে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। এর ফলে সাইক্লোন ট্র্যাকিং, উপকূলীয় বন্যা মডেলিং, জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি মাছ ধরার অঞ্চলগুলো পুনর্বিন্যাস করে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যাবে। এতে মাছ ধরার উপযুক্ত এলাকা চিহ্নিত করে টেকসই মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবে।

এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও লবণাক্ততার তথ্য বিশ্লেষণ করে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানেও সহায়তা পাওয়া যাবে। এই উদ্যোগটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৪ নম্বর লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরাসরি ভূমিকা রাখবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন বলেন, "পাকিস্তান ও ভারতসহ অনেক দেশেই ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন রয়েছে এবং তারা তা ব্যবহার করে সমুদ্রসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এখনও পিছিয়ে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মনিটর করে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ এবং বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা গেলে দেশের সামুদ্রিক অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে যাবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের গ্র্যাজুয়েট ও শিক্ষকরা নতুন উদ্যমে গবেষণায় যুক্ত হতে পারবেন।"

প্রকল্পের নথিপত্র অনুযায়ী, নতুন প্রযুক্তি স্থাপন হলে দেশের সমুদ্র ও বিমানবন্দর, এয়ারলাইনসসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য, পূর্বাভাস, সতর্কতা ও পরামর্শ দেওয়া সম্ভব হবে। ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে (যেমন–আইপিসিসি রিপোর্ট) সহযোগিতা করা যাবে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাব হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারবে এই স্টেশন।

এই স্থাপনাটির অর্থায়নের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে—আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার জন্য উচ্চ রেজোলিউশন ডেটা প্যাকেজ বিক্রি, মৎস্য, জ্বালানি ও শিপিং কোম্পানির জন্য ডেটা সাবস্ক্রিপশন সেবা, এবং সরকারি বাজেট থেকে নির্দিষ্ট বরাদ্দ। এছাড়া প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও এসএমএস ভিত্তিক ফিশিং অ্যালার্ট সিস্টেমের জন্য সাবস্ক্রিপশন ফি থেকেও আয় করার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের পরবর্তী পরিকল্পনায় রয়েছে—বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের জন্য 'স্যান্ডউইচ প্রোগ্রাম' এবং চীনে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞদের একটি পুল গঠন করা। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কারিকুলাম সমন্বয়ের উদ্যোগও নেওয়া হবে।

প্রযুক্তির আধুনিকায়নে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সংযুক্তকরণ, মেশিন লার্নিং-ভিত্তিক ঘূর্ণিঝড় পূর্বাভাস মডেল, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রস্তুতি এবং কক্সবাজারে দ্বিতীয় ডেটা সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা। কৌশলগত অংশীদারত্বে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে আবহাওয়া তথ্য সরবরাহ চুক্তি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-এর সঙ্গে ডুয়াল-ইউজ চুক্তি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণের উদ্যোগ রয়েছে।

জাতীয় স্যাটেলাইট নীতিমালা-২০২৬-এর মাধ্যমে সমুদ্র তথ্যকে 'কৌশলগত সম্পদ' হিসেবে ঘোষণা এবং তথ্য রপ্তানিতে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ প্রটোকল প্রণয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে উপকূলীয় জেলেদের জন্য এসএমএস ভিত্তিক সতর্কতা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধির কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশের আবহাওয়া ও সমুদ্র পূর্বাভাস খাত স্বনির্ভর হয়ে উঠবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি দেশের সমুদ্র অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এই ওশান স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন।"

নবীনতর পূর্বতন