ধোঁয়াশায় ঘেরা সাত কলেজের ভবিষ্যৎ, বাড়ছে জটিলতা

ধোঁয়াশায় ঘেরা সাত কলেজের ভবিষ্যৎ, বাড়ছে জটিলতা
রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে কলেজগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করার ঘোষণা দিলেও এবার তা বাস্তবায়ন করা নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন জটিলতা। বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়ে গেলে জাতীয় পর্যায়ে স্বমামধন্য এই কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

সম্প্রতি সাত কলেজের উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের একাংশের দাবি অনুযায়ী সরকার বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেয়। এতে ঐ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসলেও শেষমেশ বেঁকে বসেছেন কলেজগুলোর শিক্ষক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা। এতে নতুন এক জটিলতার সম্মুখীন হয়েছে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই সাতটি কলেজে কর্মরত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত শিক্ষক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অবস্থান কি হবে, সেটা স্পষ্ট না হওয়ায় এ নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। সম্প্রতি নিজেদের অবস্থান নিশ্চিতকরণ এবং কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দাবিতে পৃথকভাবে আন্দোলনে নেমেছেন তাঁরা। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই স্নাতক/স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরাও। শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করে প্রস্তাবিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলের ব্যাপারে আপত্তি জানান ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের একাংশ।

এর আগে, চারদিন পূর্বে বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। খসড়া অধ্যাদেশ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ—এই সাতটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত কাঠামোর ভিত্তিতে গড়ে উঠছে প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়।

এর মধ্যে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ মিলিয়ে হবে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব সাইন্স। সরকারি বাঙলা কলেজে স্থাপিত হবে আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ স্কুল, সরকারি তিতুমীর কলেজে হবে বিজনেস স্টাডিজ স্কুল এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ মিলিয়ে হবে ল অ্যান্ড জাস্টিস স্কুল।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, প্রস্তাবিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে হাইব্রিড পদ্ধতিতে। ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে অনলাইনে ও ৬০ শতাংশ অফলাইনে। তবে শিক্ষার্থীদের সব পরীক্ষা দিতে হবে সশরীরে।

মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইটে এই খসড়া অধ্যাদেশের ওপর অংশীজনদের মতামত আহ্বান করা হয়েছে।

অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশের পরপরই মূলত নড়েচড়ে বসেন সাত কলেজের শিক্ষকেরা। সাতটি সরকারি কলেজকে একীভূত করে প্রস্তাবিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতে আপত্তি জানিয়ে একযোগে নিজ নিজ কলেজে মানববন্ধন করেন।

তাঁরা বলছেন, প্রস্তাবিত কাঠামো বাস্তবায়িত হলে কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষা ও নারীশিক্ষার সংকোচন ঘটবে এবং কলেজের স্বতন্ত্র কাঠামো ও ঐতিহ্য বিলুপ্ত হবে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের (শিক্ষক) পদও বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রকারান্তরে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হবে।

শিক্ষকদের মতে, সাত কলেজের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় হোক, সেটির বিপক্ষে তাঁরাও নন। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অবশ্যই পৃথক স্থানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে অধিভুক্তিমূলক। কলেজের নাম বা কাঠামো পরিবর্তন করে কোনো অনুষদে অথবা স্কুলে রূপান্তর করা যাবে না। বিদ্যমান কোনো বিষয় বিয়োজন করা যাবে না। সাত কলেজের লোগোসহ স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নিজ নিজ কলেজের নামে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।

তাদের দাবি, প্রয়োজনে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’-এর ক্যাম্পাস অবশ্যই পৃথক স্থানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাত কলেজকে পরীক্ষাগার বা গিনিপিগ বানিয়ে কোনো পরীক্ষামূলক বিশ্ববিদ্যালয় মডেল চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।

এসব দাবির পক্ষে শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা বলছেন, ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের জায়গা সংকুচিত করে কেন কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে হবে? কলেজের অবকাঠামো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো এক নয়। কলেজের অবকাঠামোতে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে পারেনি। এখন আবার এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভাবা হচ্ছে, যার মাথা সাতটি। কোনো কারণে একটি মাথায় শিক্ষার্থী অসন্তোষ শুরু হলে সাতটি মাথাতেই অসন্তোষ শুরু হবে, যার পরিণতি সারা ঢাকা শহর অচল হয়ে যাওয়া।’

জানা যায়, শিক্ষা ক্যাডারে প্রায় ১৯ হাজার সদস্য রয়েছেন, যাঁদের সিংহভাগই দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। এর মধ্য থেকে খুব অল্পসংখ্যক কর্মকর্তা শিক্ষা প্রশাসনে পদায়ন পান। তবে রাজধানীতে এ সাতটি সরকারি কলেজে প্রায় এক হাজার ৫০০ শিক্ষা ক্যাডার সদস্য কর্মরত। এই সাতটি কলেজ মিলে বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখান থেকে শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদেরও চলে যেতে হতে পারে। এতে শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসে পদ সংখ্যা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষকরা।

সাতটি সরকারি কলেজের মধ্যে ইডেন মহিলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ ব্যতীত বাকি পাঁচটি কলেজেই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় রয়েছে।

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হলে কলেজের স্বতন্ত্র কাঠামো ও ঐতিহ্য নষ্ট হবে বলে দাবি করেছেন ঢাকা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ও সরকারি বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের (এইচএসসি) শিক্ষার্থীরা। কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা বিগত সপ্তাহে নিজ নিজ ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সংবাদ সম্মেলনের মতো কর্মসূচি পালন করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসে প্রস্তাবিত ইউনিভার্সিটির স্কুল অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে। এটি হলে স্নাতকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজ নামের প্রতিষ্ঠানের কোনো সংযোগ থাকছে না। আবার ‘টাইম শেয়ারিং’ মাধ্যমে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস এবং এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।

বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রীদের অভিযোগ, ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ জারি হলে রাজধানীতে ‘নারী উচ্চশিক্ষা সংকোচন’ হবে ও ‘শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ’ বাড়বে। এই কলেজে অধ্যয়নরত প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র এক হাজার ২০০ জন ভর্তির সুযোগ পাবেন। বিশেষ করে মেয়েদের উপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বেগম বদরুন্নেসার যে পরিচয়, তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সরকারি বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা আশঙ্কা করেন, ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হলে কলেজের নিজস্ব পরিচয় ঢাকা পড়ে যাবে। এতে পরিচয়হীন হওয়া কিংবা অবহেলার শিকার হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কার কথাও জানান তারা।

তবে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘রাজধানীর সাত কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের কোনো ক্ষতি হোক, সেটা আমরা চাই না। কারণ এটা তাদের ঐতিহ্য। এ ব্যাপারে আমরা খুবই সচেতন। বরং উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিসহ অন্যান্য সুবিধা ব্যবহার করতে পারে, সে ব্যবস্থা আমরা রেখেছি। অবশ্যই উচ্চ মাধ্যমিক আমাদের প্রায়োরিটি।’

স্ব স্ব কলেজের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির হাইব্রিড (স্কুলিং) পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের একাংশ। সাত কলেজের স্বতন্ত্রতা রক্ষা এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে অক্সফোর্ড মডেলের বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করেন তারা। এ মডেল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র ডিগ্রি প্রদান, পাঠ্যক্রম নির্ধারণ, পরীক্ষা আয়োজন, গবেষণার দিকনির্দেশনা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অপর দিকে, কলেজসমূহ প্রশাসনিক ও আর্থিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত হয়ে থাকে। এই মডেলে কলেজসমূহে নিজস্ব গভর্নিং বডি ও সম্পদ থাকে।

সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এমন ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের কারণে চারটি আলাদা পক্ষ তৈরি হয়েছে কলেজগুলোতে। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের একপক্ষ স্কুলিং পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় চায়, অপরপক্ষ অক্সফোর্ড মডেল দাবি করে। অন্যদিকে শিক্ষক সমাজ এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদেরও রয়েছে ভিন্ন অবস্থান। শিক্ষকদের দাবি, অধিভুক্ত পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়ন নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা চায় কলেজের এবং তাদের নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে।

সব মিলিয়ে আবারও এক ধরণের অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে কলেজগুলোতে।

নবীনতর পূর্বতন