নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত বয়সসীমা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পূরণ না করলেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) ও এর নিয়ন্ত্রণাধীন আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসব নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। ফলে ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি তহবিলে প্রায় ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বয়সসীমা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করেও বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি দিয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে। এতে শুধু আর্থিক ক্ষতিই হয়নি, বরং নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। এ ধরনের অনিয়ম বন্ধে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং অবৈধভাবে প্রদত্ত টাকা ফেরত আনার সুপারিশ করেছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।
নিরীক্ষা অনুযায়ী, ইউজিসি, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের নির্ধারিত প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ প্রদান ও বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার ২৩৯ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তদারক সংস্থা ইউজিসি কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদোন্নয়ন নীতিমালা সংলগ্নী-১-এর সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক পদে চার বছর মেয়াদি স্নাতক ও নিয়মিত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকা আবশ্যক উল্লেখ করা হলেও ওই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত মো. জাহিদুল ইসলাম স্নাতকোত্তর হিসেবে সান্ধ্যকালীন প্রফেশনাল মাস্টার অব সায়েন্স ইন কম্পিউটার সায়েন্স (প্রফেশনাল এমএসসি) ধারী ছিলেন; যা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে নিরীক্ষায় চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইউজিসি, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের নির্ধারিত প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ প্রদান ও বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার ২৩৯ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তদারক সংস্থা ইউজিসি কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদোন্নয়ন নীতিমালা সংলগ্নী-১-এর সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে।
সান্ধ্য প্রফেশনাল কোর্স সাধারণত কর্মরত চাকরিজীবীদের অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে গণ্য হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত স্নাতকোত্তর সম্পন্ন ছাড়া প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ফলে ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭২০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র অধ্যয়ন বিভাগের প্রভাষক নিয়োগ সংক্রান্ত শর্তও লঙ্ঘন করা হয়েছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনকারীর এসএসসি বা সমমান এবং এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০-এর মধ্যে ন্যূনতম জিপিএ ৪.২৫ থাকতে হবে। নিরীক্ষায় পাওয়া দাপ্তরিক নথি অনুযায়ী মো. মাইনুল ইসলাম এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.১৩ ও এইচএসসিতে জিপিএ ৪.২০ পেয়েছেন; তবু তার আবেদন বাতিল না করে নিয়োগ প্রদান ও বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়েছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) পদের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পর্যায়ে কমপক্ষে ১৫ বছরের বাস্তব চাকরির অভিজ্ঞতা এবং অর্থ ও হিসাব দপ্তরে উপপরিচালক/পরিচালক পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থাকা চাওয়া হয়েছিল। নিয়োগপ্রাপ্ত মো. গোলাম সরোয়ারের জমা দেওয়া নথিতে দেখা যায় যে তার প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পর্যায়ের অভিজ্ঞতা মাত্র ১২ বছর ৫ মাস ১৩ দিন; রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত মো. সোহরাব আলীর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পর্যায়ে অভিজ্ঞতা ছিল ১১ বছর ৫ মাস ২৮ দিন। অর্থাৎ অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ না করলেও এই দুই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এসব নিয়োগ এবং তাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এক কোটি ৬৬ লাখ ৭ হাজার ৭১৩ টাকা।
জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের শেষ তারিখে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর নির্ধারণ করা ছিল। তবে এই পদে নিয়োগ পাওয়া এস এম মুদাব্বির হোসেনের আবেদনের সময় বয়স ছিল ৩২ বছর ৩ মাস ২১ দিন। ফলে বয়সসীমার শর্ত লঙ্ঘন করে নিয়োগ ও বেতন-ভাতা প্রদানের কারণে সরকারের ২৬ লাখ ৫৫ হাজার ৪০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে নিরীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী পদের নিয়োগেও অনুরূপ অভিজ্ঞতা ও প্রোবেশনকাল সংক্রান্ত বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। সেখানে নিয়োগপ্রাপ্ত মো. শাহরিয়ার শাহানের মোট অভিজ্ঞতা ছিল ১০ বছর ১০ মাস এবং পূর্বপদের প্রোবেশনকালও শেষ হয়নি; নিরীক্ষা অনুযায়ী ওই নিয়োগের ফলে ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৩৭০ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর জানিয়েছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব নিয়োগের মাধ্যমে ট্রেজারি রুলস ও অডিট কোডের নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিজ্ঞপ্তির শর্ত না মেনে নিয়োগ দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করেছে। প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে বেতন-ভাতা ফেরত আনা, দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভবিষ্যতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কড়া তদারকির সুপারিশ করা হয়েছে।
ইউজিসি, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগের কোনো জবাব দেয়নি। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, ‘রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, ‘প্রার্থীকে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করার জন্য বলা হবে।’ শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম প্রসঙ্গে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত যোগ্যতা শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত পরিপত্রের আলোকে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।’
কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি জানিয়েছে, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাসঙ্গিক পরিপত্র অনুযায়ী ২০০১, ২০০২ ও ২০০৩ সালে ৪.০০ বা তদূর্ধ্ব সিজিপিএকে প্রথম শ্রেণির সমমান ধরা হয়েছে; সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত শর্ত অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যোগ্যতা আছে।’ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বলা হয়েছে, ‘বাউবি আইন-১৯৯২ এর ধারা-২০(চ) মোতাবেক বোর্ড অব গভর্নরস কর্তৃক নিয়োগ প্রদানের পর তিনি যথানিয়মে যোগদান করেছেন। নিরীক্ষক এই জবাবটি আপত্তি নিষ্পত্তির সহায়ক না বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির অডিট শাখার পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘যে সব বিষয়ে আপত্তি এসেছে, কমিশন সে সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা অভিযুক্তদের কাছে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা বা মতামত নিয়েছি। সেগুলো নিয়ে আগামী সপ্তাহে আলোচনা করা হবে। পরবর্তীতে রিপোর্ট আকারে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হবে।’
শিক্ষাবিদদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে এ ধরনের অনিয়ম চলতে থাকলে উচ্চশিক্ষার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি দেশের গবেষণা ও শিক্ষা পরিবেশও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে। তাই নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে তারা মত দিয়েছেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হলে উচ্চশিক্ষালয়গুলোকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওয়াতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দ্রুত জবাবদিহি নিশ্চিত করে নিরীক্ষার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এটি না করা গেলে সরকারি তহবিলের অস্বচ্ছ ব্যয় ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিনিয়ত নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশি উচ্চশিক্ষার ওপর স্থায়ী ক্ষতি আনতে পারে।
