ছাত্রদলের কমিটি ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আতঙ্ক

ঢাকা মহানগরের চারটি শাখা এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ আরও পাঁচটি কলেজে আহবায়ক ও আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী
ছাত্রদলের কমিটি ঘিরে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আতঙ্ক

ঢাকা মহানগরের চারটি শাখা এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ আরও পাঁচটি কলেজে আহবায়ক ও আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্দোলনে নেমেছেন পদবঞ্চিতরা। দুদিন ধরে বিক্ষোভ-আন্দোলন চলছেই। আজ বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে চাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

পদবঞ্চিতদের আন্দোলন-বিক্ষোভ দেখা গেছে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আন্দোলন চলাকালীন ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ এবং কবি নজরুল কলেজে ককটেল বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানীর উত্তরা বিএনএস টাওয়ার, তেজগাঁও কলেজ, বাঙলা কলেজসহ অন্তত সাতটি স্থানে সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন পদবঞ্চিতরা। এ সময় ক্যাম্পাসে অবস্থান করা শিক্ষার্থী এবং সড়কে চলাচল করা সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

‘বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে সেগুলো মাত্র ৪৫ দিনের জন্য সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি। অর্থাৎ আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে সম্মেলন আয়োজন করে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ব্যবস্থা করে বর্তমান শিক্ষার্থীদেরকে নেতৃত্ব হস্তান্তর করবে। এই কমিটির দায়িত্ব মূলত ৪৫ দিনের মধ্যে বর্তমান শিক্ষার্থীদের হাতে নেতৃত্ব হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা।’—নাছির উদ্দীন নাছির, সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল

পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের অভিযোগ, গত ১৫ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে যারা কখনোই ছিল না, এমন ব্যক্তিদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি, অছাত্র, বিবাহিত এবং অপরিচিতদের নিয়ে আহবায়ক ও আংশিক কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও ছাত্রদলের দাবি, ত্যাগীদের দিয়েই কমিটি গঠন করা হয়েছে। আন্দোলনকারীরা সংখ্যায় ‘কম’।

এ বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক  নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একটি বৃহত্তর সংগঠন। আন্দোলন সংগ্রামের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় অসংখ্য ছাত্রদল নেতা নিজ নিজ ইউনিটের শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। কিন্তু সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে আমরা সবাইকে প্রত্যাশিত পদে দিতে পারছি না। কিন্তু যারা প্রত্যাশিত পদ পায়নি তারা যোগ্য নয় এমন না। পদবঞ্চিত হলে বা যথাযথ মূল্যায়ন না হলে যদি কেউ ক্ষুব্ধ হয় তাহলে তার ক্ষোভের প্রকাশ অবশ্যই গণতান্ত্রিক রীতি এবং সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করতে হবে। কোনোভাবেই দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা যাবে না। আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক জনাব তারেক রহমান সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। আমরাও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছি।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে সেগুলো মাত্র ৪৫ দিনের জন্য সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি। অর্থাৎ আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে সম্মেলন আয়োজন করে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ব্যবস্থা করে বর্তমান শিক্ষার্থীদেরকে নেতৃত্ব হস্তান্তর করবে। এই কমিটির দায়িত্ব মূলত ৪৫ দিনের মধ্যে বর্তমান শিক্ষার্থীদের হাতে নেতৃত্ব হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা।’

ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির আরও বলেন, ‘সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আকার সেশন অনুসারে সমন্বয় করেই দ্রুত বৃদ্ধি করা হবে।’

‘সদ্য ৩২ সদস্যের যে কমিটি দেয়া হয়েছে এই কমিটিতে পাচঁ-সাতজন ছাড়া কাউকে তেমন চিনিও না। আমরা একটা সূত্র থেকে জানতে পারলাম প্রত্যেকটা নেতাকর্মী টাকার বিনিময়ে কমিটিতে জায়গা পেয়েছে। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পরে আমরা জীবনবাজি রেখে রাজপথে ছিলাম। রাজপথে থাকার পরে দলীয় যে নির্দেশনা দিয়েছে সব যথাযথভাবে পালন করেছি।’—মো. মেশকাত হোসেন, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তেজগাঁ কলেজ ছাত্রদল

এর আগে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপির সহযোগী এ ছাত্র সংগঠনটি ভেরিফায়েড পেজে ছাত্রদলের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম শাখা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আংশিক কমিটি, ঢাকা পলিটেকনিক, ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বাংলা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ ও তেজগাঁও কলেজের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। কমিটি ঘোষণার পর থেকে পদবঞ্চিতরা আন্দোলনে নামেন।

ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের নেতাকর্মীরা বলছেন, ছাত্রদলের নতুন কমিটির কমবেশি সবাই রাজপথের আন্দোলনে সরব ছিলেন এবং যার যার জায়গা থেকে কাজ করেছেন। বিএনপির হাইকমান্ড ছাত্রদল নেতাদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করেছেন। ‘ত্যাগী’ ও ‘যোগ্য’দের সমন্বয়ে কমিটি দেওয়া এবং মাঠের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি দেখা গেছে। 

তবে পদবঞ্চিতদের কয়েকজন নেতা তাদের অবমূল্যায়নেরও অভিযোগ তুলেছেন। আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেও কেউ কেউ কমিটিতে পদ না পেয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। তাদের মতে, আন্দোলন-সংগ্রামে যারা ভূমিকা রেখেছিল তাদের নিয়ে পুনরায় আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা উচিত। জুলাই আন্দোলন এবং তার পূর্বে যারা রাজপথে সক্রিয় ছিল, গুম, হামলা-মামলা কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাদের আহবায়ক কমিটিতে রাখা দরকার ছিল। 

এ বিষয়ে ছাত্রদল ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মনির বলেন, অযোগ্য, নিষ্ক্রিয় ও ভাড়াটিয়াদের দিয়ে কমিটি গঠন করার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। স্বৈরাচার আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণদের উপেক্ষা করা হয়েছে। যারা হামলা-মামলার শিকার হয়েছিল, গুমের শিকার হয়েছিল তাদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়নি। অতীতে যখন প্রোগ্রাম হত, তখন একটি মিছিলে ৬-৭ জনের বেশি কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করা সেই নেতাকর্মীদেরই কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়নি। অবিলম্বে এই কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি ঘোষণার দাবি জানান এ নেতা। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সোলাইমান সাগর বলেন, ‘২৪ এর জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা হয়েছে। সেই সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্রদলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।’ 

তিনি বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পরে সিনিয়র থেকে জুনিয়র পর্যায়ের সকল ত্যাগী ও হামলা-মামলার শিকার নেতাকর্মীদের পদবঞ্চিত করে অছাত্র, ছাত্রলীগের কর্মীদের দ্বারা এবং বিপ্লবোত্তর সময়ে রাজনীতিতে আসা হাইব্রিডদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রেখে যারা জীবন বাজি রেখেছেন তাদেরকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। বিশেষ করে ১১তম ব্যাচকে (২০১৫-১৬ সেশন) ইচ্ছাকৃতভাবে পদবঞ্চিত করা হয়েছে।’ 

পদবঞ্চিত ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমি ঢাকা কলেজ ভর্তির পর থেকে ছাত্রদল করি, ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত। এ পর্যন্ত যত প্রোগ্রাম ছিল, সব প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। ২০১৭ সালে যে কমিটি হয়েছিল, সেখানে সদস্য ছিলাম এবং তার পরের কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। গত ২৮ অক্টোবরের পরে আমার জীবন বাজি রেখে রাজপথে ছিলাম । রাজপথে থাকার পর দলীয় যে নির্দেশনা দিয়েছে সব যথাযথভাবে পালন করেছি । জলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেশনায়ক তারেক রহমানের নির্দেশে সাধারণ ছাত্রদের পাশে থেকে আমরা সায়েন্সল্যাব, ঝিগাতলা ও ঢাকা কলেজ এলাকায় আন্দোলন চালিয়ে যাই।’

তিনি বলেন, ‘দলের একটি খারাপ চক্র তারা দলের ভেতর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করার জন্য তারা সামাজিকভাবে অনেক পাঁয়তারা করে এবং দেখা যাচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে কালকে একটা কমিটি হয়েছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী ছাত্রলীগের একটি চক্র সক্রিয় ছিল। সেই চক্র ঢাকা কলেজের যে কমিটি হয়েছে, সেই কমিটিতে জায়গা পেয়েছে। এই কমিটিতে ছাত্রলীগের অনেক কর্মী আছে ডকুমেন্টসহ আমরা দফতরে দেব। আমাদের ৩৬ জনের কমিটিতে ৪-৫ জন ছাত্রলীগের কর্মী  আছে। জলাই গণ-অভ্যুত্থানে যারা সায়েন্সল্যাবে আমাদের ওপর হামলা করেছে তারাই আজ ছাত্রদলের  কমিটিতে এসেছে। আর আমরা যারা সাধারণ ছাত্রদের পাশে ছিলাম, আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম, দেশনায়ক তারেক রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী চলেছি তারা আজ পদবঞ্চিত।’

তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মেশকাত হোসেন বলেন, ‘সদ্য ৩২ সদস্যের যে কমিটি দেয়া হয়েছে এই কমিটিতে পাচঁ-সাতজন ছাড়া কাউকে তেমন চিনিও না। আমরা একটা সূত্র থেকে জানতে পারলাম প্রত্যেকটা নেতাকর্মী টাকার বিনিময়ে কমিটিতে জায়গা পেয়েছে। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পরে আমরা জীবনবাজি রেখে রাজপথে ছিলাম। রাজপথে থাকার পরে দলীয় যে নির্দেশনা দিয়েছে সব যথাযথভাবে পালন করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থানে দেশনায়ক তারেক রহমানের নির্দেশে সাধারণ ছাত্রদের পাশে থেকে আমরা ফার্মগেইট এলাকায় আন্দোলন চালিয়ে যাই। দলের একটি খারাপ চক্র তারা দলের ভেতর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টির জন্য অনেক পাঁয়তারা করে এবং দেখা যাচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল একটা কমিটি হয়েছে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

Cookie Consent
We serve cookies on this site to optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.